বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি, এসবের পরিপন্থি বড় একটি শক্তিধর রাজনৈতিক দল হচ্ছে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ'। দলটি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন পেতে নাম পরিবর্তন করে 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী' নাম ধারণ করে। নাম পরিবর্তন করা তাদের টিকে থাকার কৌশল। দলটির প্রকৃত নাম, আদর্শের নাম, জন্মগত নাম 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ'। দলটি বাংলাদেশে শাখা প্রতিষ্ঠার সময় 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' এবং 'বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী'-এর মধ্যে পার্থক্য কি? দু'টি নামের পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আদর্শগত। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বললে বোঝাবে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান। যেমন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। এই দল দু'টি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত বলে বাংলাদেশ শব্দটি আগে লেখা হয়েছে। 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' বললে বোঝাবে দলটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নয় এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ শাখা হিসেবে। তাই বাংলাদেশ পরে লেখা হয়েছে। যেমন- 'লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ'। লিভার ব্রাদার্স ইংল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই 'লিভার ব্রাদার্স বাংলাদেশ' লেখা হয়েছে। অনুরূপভাবে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' মানে বাইরের দেশ থেকে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর 'বাংলাদেশ শাখা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশ পরে লেখা হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী হিন্দের শাখা হিসেবে 'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট পাকিস্তানের লাহোরে প্রতিষ্ঠা হয় জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। মওলানা আবুল আলা মওদুদী দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় দলটি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল? তৎকালীন সময়ে ভারত বর্ষে 'জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ' নামে একটি আলেম সংগঠন ছিল। সংগঠনটির অবস্থান ছিল ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে। সংগঠনটির অনেক আলেম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। সংগঠনটির মুখপত্র ছিল 'আল জমিয়ত'। মওলানা মওদুদী 'আল জমিয়ত' পত্রিকায় চাকরি করতেন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিলে মওলানা মওদুদী 'আল জমিয়ত' পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করেন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষাবলম্বন শুরু করেন। ভারতের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। এই অবস্থায় তিনি 'জামায়েতে ইসলামী হিন্দ' রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সঙ্গে মওলানা মওদুদীর তখন ধর্মগত বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়নি। মতপার্থক্য ছিল রাজনৈতিক। এতে জামায়াতে ইসলামী হিন্দের জন্মের প্রেক্ষাপট ধর্মগত নয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বলেই প্রতিয়মান হয়। জামায়াতে ইসলামী হিন্দের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ কি ছিল? দলটি জন্মের পর থেকেই ভারতের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করে। এমনকি মওদুদী ব্রিটিশের পক্ষে ফতোয়া দেয়। মওদুদী বলেছেন, 'যদি আপনার ইংরেজের সঙ্গে শত্রম্নতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছয় হাজার মাইল দূরে হতে এসেছে, আপনার দেশের বাসিন্দা নয়, তবে আপনার এ শত্রম্নতা ইসলামী শত্রম্নতা নয়- অজ্ঞতা প্রসূত শত্রম্নতা'।
এতে বুঝা যায় ব্রিটিশের পক্ষাবলম্বন করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াতে ইসলামীর জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশে এই জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামের রক্ষক, সেবক বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। জামায়াতে ইসলামী যদি ইসলাম রক্ষার বা সেবার জন্য জন্ম হয়, জামায়াত করলে যদি আলস্নাহ পাওয়া যায়- বেহেশত পাওয়া যায় তাহলে মওলানা মওদুদী তার কোনো সন্তানকে জামায়াতে ইসলামীতে যুক্ত করেননি কেন? মওদুদী নিজের সন্তানদের জামায়াতে ইসলামীতে যুক্ত না করানোতেই প্রমাণ হয় ইসলামের জন্য জামায়াতে ইসলামীর জন্ম দেওয়া হয়নি। অন্য উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামীকে জন্ম দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, মওলানা মওদুদীর সন্তানরাও ইসলামের জন্য জামায়াতের আদর্শ ধারণ করেননি। বরং জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। মওলানা মওদুদীর পুত্র হায়দার ফারুক মওদুদী জামায়াতের রাজনীতিকে 'ধর্মীয় রাজনীতির নামে জামায়াতের ভন্ডামি' বলে অভিহিত করেছেন।
মওলানা মওদুদী এবং তার দল জামায়াতে ইসলামী ভারতের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামী দল মুসলিম লীগ সম্পর্কে মওদুদী ও জামায়াত বলত, মুসলিম লীগে একজনও সাচ্চা মুসলমান নেই। পাকিস্তানে স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে মওলানা মওদুদী বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র হবে 'আহাম্মকের বেহেশত এবং কাফেরানা রাষ্ট্র'। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীন হলে মওদুদী জন্মস্থান ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান। এরপর স্বাধীন পাকিস্তানে ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানিদের কাফের ঘোষণা করে তার দল জামায়াতকে দিয়ে পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। চার বছরব্যাপী দাঙ্গায় জামায়াত অনুসারীদের হাতে ৩ লাখ মানুষ হত্যা হয়েছিল। এই দাঙ্গা স্বাধীন পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র বলে ধরা যায়। জামায়াত তাই ইসলামের মূল দর্শনধারী নয় ষড়যন্ত্রকারী বলে যুগে যুগে চিহ্নিত। দাঙ্গা বাধানোয় ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে আবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ভারতে ১৯৯২ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর জামায়াতকে একবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলার ঘটনার দায়ী সাব্যস্ত করে দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। মুসলমান জাতির জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার কথা তখন বলা হয়েছিল। ১৯৪০ সালে উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে ভারতে মুসলমানদের জন্য পৃথক মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এরপর ১৯৪১ সালের আগস্টে পাকিস্তানের লাহোরে জামায়াতে ইসলামী হিন্দের জন্ম হয়। জন্মের পর থেকেই দলটি ভারতে পাকিস্তান রাষ্ট্র অর্থাৎ মুসলমান রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা শুরু করে। শুধু বিরোধিতা নয়, মওলানা মওদুদী পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনৈসলামিক কর্মকান্ড বলেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের কাফের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী যদি ইসলামের স্বার্থ রক্ষার জন্য জন্ম হয়, দলটি ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের স্বার্থে মুসলমান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করল কীভাবে? পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটি জন্মস্থান পাকিস্তানের মানুষের কাছে বর্তমানে গুরুত্বহীন অবস্থায় রয়েছে। কারণ পাকিস্তানের মানুষ মওলানা মওদুদীর ভন্ডামি এবং ধর্মের লেবাস পরা জামায়াতে ইসলামীর জন্ম সম্পর্কে সচেতন।
১৯৪৭ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পাকিস্তানে বাঙালি, পাঞ্জাবি, বিহারি, বালুচ, বিভিন্ন জাতি ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ছিল বাঙালি। পূর্ববাংলা ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির ওপর নিষ্পেশন ও শোষণ শুরু হয়।
১৯৪৮ সালে বাংলাভাষার ওপর প্রথম আঘাত আসে। এতে বাঙালির মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। বাঙালি নিষ্পেশন, শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার অধিকার দাবিতে বাঙালিকে প্রাণ দিতে হয়। এরপর বাঙালি ধারাবাহিক আন্দোলন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাত্রিতে পাকিস্তান বিশ্ব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালায় বাঙালির ওপর। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। এরপর জামায়াতে ইসলামী 'রাজাকার', 'আলবদর', 'আল শামস' বাহিনী গঠন করে। জামায়াতে ইসলামীর বাহিনীগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় নির্বিচারে গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারী ধর্ষণ করে।
উলেস্নখ্য, আমেরিকা এবং চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্টান এলাকায় রাজাকারের বর্বরতা ছিল না। এতে বোঝা যায় আমেরিকা এবং চীনের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ ছিল। বলা যায়, জামায়াতে ইসলামীর এসব বর্বরতায় আমেরিকা-চীনের সমর্থন ও উস্কানি ছিল। বলা যায়, জামায়াতে ইসলামী আমেরিকা এবং চীনের স্বার্থ রক্ষা করেছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর কাছে ইসলামের স্বার্থ ছিল কিনা? জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক মুসলমান গ্রামগুলোতে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করার সময় ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়েও নিবৃত করা যায়নি। এতে বুঝা যায়, জামায়াতের কাছে ইসলামের আদর্শই ছিল না। আবার জামায়াতে ইসলামী গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করার সময় শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমানদের করেনি। নির্বিচারে সাধারণ মুসলমান গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ করেছে। জামায়াতে ইসলামী যদি ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য জন্ম হয় তাহলে সাধারণ মুসলমানদের নির্বিচারে নিধন ও নারী ধর্ষণ করল কীভাবে? এতে প্রমাণ হয় ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়ন নয় মওদুদীবাদ বাস্তবায়ন জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ।
ইসলামের জন্য জন্ম হলে জামায়াত পরিচালিত হতো কোরান এবং হাদিসের নির্দেশ এবং বাণীর আলোকে। কিন্তু জামায়াত পরিচালিত হয় মওলানা মওদুদীর তত্ত্বে। জামায়াত ও মওদুদী আলস্নাহ এবং রাসূলের অনেক নির্দেশ ও বাণীর বিরুদ্ধাচারণ, অপব্যাখ্যা ও মনগড়া ব্যাখ্যা করেছে। যেমন আলস্নাহ বলেছেন, রাসূল নিষ্পাপ। মওদুদী ফতোয়া দিয়েছেন, 'হযরত মোহাম্মদ মানুষ, তার জীবনও দোষত্রম্নটি মুক্ত নয়'। সমগ্র বিশ্বের আলেমরা মওদুদীর এই মনগড়া ফতোয়া প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিশ্বের আলেম সমাজ হযরত মোহাম্মদ (স.) এর জীবন দোষত্রম্নটিমুক্ত বলেছেন। কিন্তু জামায়াত মওদুদীর সেই মনগড়া ফতোয়াকে আদর্শ ধারণ করেছে। মোদ্দা কথায় বলা যায়, ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নয়, ব্রিটিশের দালালি এবং মওদুদীবাদ বাস্তবায়নের জন্যই জন্ম হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর।
\হ
রোকন উদ্দীন আহমদ : গবেষক ও কলাম লেখক