গণতান্ত্রিক দেশে আন্দোলন বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রথা। কোনো বিষয়ে মতৈক্য হতে না পারলে তার প্রতিবাদ জানানোটা স্বাভাবিক। প্রতিবাদটি হতে হবে শান্তিপূর্ণ। জনগণের কোনোরূপ ক্ষতিসাধন হবে এ ধরনের বক্তব্য প্রতিবাদকারী বা প্রতিবাদ প্রতিহতকারীর দেওয়া উচিত না। প্রতিবাদটি বা প্রতিরোধটি যদি ধ্বংসাত্মক হয় তাহলে গণতন্ত্র পরাভূত হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষাকল্পে সবারই এই বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের কোটা ব্যবস্থায় বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। বৈষম্য নিরোধকল্পে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলনে মাঠে নামে। এই আন্দোলনটি বাংলাদেশে কোটাবিরোধী আন্দোলন নামে পরিচয় লাভ করে। প্রকৃতার্থে এটা কোটাবিরোধী নয়, এর মূল বিষয়টি হলো কোটা সংস্কার ও বৈষম্যনিরোধ। তবে এই আন্দোলনটি ছিল দল নিরপেক্ষ। আন্দোলনটিতে দৃশ্যমান কোনো রাজনৈতিক লেজুড় বৃত্তি ছিল না। তাই আন্দোলনকারীরা সাধারণ মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ সমর্থন পায়। কারণ সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থাটিতে বৈষম্যে থাকায় সর্বস্তরের মানুষ চায় এর পরির্বতন। সহজেই এই আন্দোলনটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে খুব অল্প সময়ে এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তবে দেশের কিছু কথিত সুশীল বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে অভিহিত করে।
এ রকম শ্রেণির মানুষের মন্তব্য এর কারণে সুপ্তভাবে আন্দোলনটিতে ঢুকে পড়ে জামায়াত-শিবির। কতিপয় রাজনীতিবিদ বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনটিকে রাজাকার অভিহিত করায় বড় ধরনের ঘটনার সূত্রপাত ঘটায়। সারাদেশে সুপ্ত অবস্থায় লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীরা যোগ দেয় ভিন্ন এক কৌশলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। এর ফলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি ভয়ংকররূপ নেয়। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনটি এখন বিষাক্ত। কিছু মহলের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় তারা চাচ্ছে সরকারের পতন। তবে বৈষম্য নিরোধ আন্দোলটি কখনোই সরকারের পতন চায়নি। তারা চেয়েছে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার। তাই কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল বিষয়টি সুদক্ষভাবে হ্যান্ডেল করা। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করা যেত। আজ দেশের সব ঘটনা অঘটন ছাপিয়ে বিষয়টি মহিরুহ রূপ নিয়েছে। কোনোভাবেই যদি এটাকে স্বাভাবিক না করা যায় তাহলে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। সম্প্রতি সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমেছেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই দুর্নীতিবাজরা কয়েকশ' কোটি নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে। এই দুর্নীতিবাজরা এই জামায়াত-শিবির যারা এই আন্দোলনে ভিন্ন কৌশলে যোগ দিয়েছে তাদের অর্থের একটি জোগানদার হিসেবেও কাজ করতে পারে। সরকারের উচ্চমহলের ভাবা উচিত ছিল দুর্নীতিবাজরা অর্থ ছিটিয়ে বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে। পুলিশের সাবেক আইজিপির দুর্নীতি আরও কিছু পুলিশ কর্মকর্তা দুদকের নজরদারিতে রয়েছে। এনবিআরের কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির এতদবিষয়ে সরকার কঠিন অবস্থায় অবস্থান করছেন। এই দুর্নীতিবাজরা গা ঢাকা দিয়েছে তবে এদের সাঙ্গপাঙ্গরা বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। এই বিষয়টিও আমলে নেওয়াটা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল। রামপুরা টিভি ভবনের ভয়ংকর তান্ডবটির সময় ওখানে দায়িত্বরত পুলিশের ভূমিকা কি ছিল? দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়, বিটিভি সহিংসতায় আক্রান্ত হলে টিভি ভবনের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা সরে যায়। বিটিভি ভবনের ভেতরে তখন মাত্র গুটি কয়েক নিরাপত্তাকর্মী ছিল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বিটিভি ভবন অরক্ষিত থাকার কারণে সুযোগ পেয়ে জামায়াত-শিবির ক্যাডারা তান্ডব চালায় বিটিভি ভবনটিতে। ১১৭ সদস্যদের একটি পুলিশ টিমকে সদর দপ্তর নির্দেশ দেয় বিটিভি ভবনে যাওয়ার জন্য। তারা খিলগাঁও থেকে ফিরে আসে। পুলিশের এই ধরনের ভূমিকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। সরকার ডক্টর ইউনূসের শ্রমিকদের মজুরি আত্মসাৎ ও নানা ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দুদক আদালতে মামলা করেছে। বেশ কয়েক মামলা চলমান ডক্টর ইউনূসের বিরুদ্ধে। মামলাগুলোর মেরিট পর্যালোচনায় বুঝা যায় যে, ডক্টর ইউনূস মামলায় হেরে যাবেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ডক্টর ইউনূস পরোক্ষভাবে বৈষম্য নিরোধ এই আন্দোনটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের ইন্ধন যোগাতে পারেন। কারণ ওয়ান এলিভেনের সময় এই ডক্টর ইউনূস একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন। তিনি তখন ভেবেছিলেন ওয়ান এলিভেনের ঢামাঢোলে শর্টকাট পদ্ধতিতে ক্ষমতায় চলে যাবেন। কিন্তু বিধিবাম তার আশা পূরণ হয়নি। তবে তিনি এখনো যে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেন না তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিবাদীরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের কাজে লিপ্ত। তাই এই জঙ্গিগোষ্ঠীরা ফাঁকফোকর খুঁজে কীভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো যায়। দেশের কথিত কিছু সুশীল দেশপ্রেমিক হয়ে তাদের সুযোগ করে দেয়। আর দেশবিরোধী এই চক্রটা একটু সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়ে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। গত ১৯ জুলাই ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞকে রাজনৈতিক সংঘাত বলা যাবে না। এটা পরিকল্পিত একটা ধ্বংসযজ্ঞ। হাজার হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করে রাজনৈতিক আন্দোলন হয় না। বৈষম্য নিরোধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সাইনবোর্ড বানিয়ে এত বড় নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে এটা ভাবা যায়নি পূর্বে। অনেকেই বলছেন, সরকারের পতনের দাবিতে এই আন্দোলন হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা কি রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক। এই সম্পদের মালিক সাধারণ জনগণ। যারা সরকারের পরির্বতন চেয়েছিলেন তাদের কাছে প্রশ্ন, রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস করলেই কি সরকারের যারা প্রতিনিধিত্ব করছেন তারা সরে যাবেন? রাষ্ট্রের সব সম্পদের মালিক জনগণ, যারা রাজনীতি করেন তারা তো জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। তাই যদি হয় তাহলে কেন হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করলেন। মেট্রোরেলের দু'টি স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেতু ভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, টোল পস্নাজাসহ সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ধ্বংস করা হয়েছে। সাভারসহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে চলেছে নারকীয় তান্ডবতা। নারকীয় লীলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫০ জন, এটা সরকারি হিসাব। তবে অসমর্থিত সূত্রগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে এ সংখ্যা আরও বেশি।
দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলগুলোর বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। কারণ বাংলা জনপদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি অনুশীলন করার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বর্তমানে দেশে কথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে একে আর গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না। এখন যা চলছে তা অনেকটা বিচ্ছিন্নবাদীদের নাশকতার স্টাইল। এর পরির্বতন জরুরি। যে কোনো বিষয়ে প্রতিবাদকরাটা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর এই প্রতিবাদ করার সময় কোনো নাশকতাবাদী প্রতিবাদকারীদের মাঝে ঢুকে নাশকতা চালায় তা খুবই ন্যকারজনক।
রাজনৈতিক অঙ্গনকে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। এর জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির এ বিষয়টি নিয়ে সংলাপে বসা প্রয়োজন। আর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করা এবং নির্মূল করাটা এখন সময়ের দাবি।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক