জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)-এর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নন এমনদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি জামুকার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নন এমনদের সনদ প্রদানের অভিযোগ এনেছেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ জুন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জামুকার মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। ওই বৈঠকে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী জাইকার মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানের অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন, জামুকা ২০১৭ সালে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের পদক্ষেপ নেয়। ফলে, ২০১৬ সালে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, এখন দেখা যাচ্ছে তারাও বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছেন। এদের কেউ কেউ জামুকার সঙ্গে সম্পর্ক করে ভুয়া সনদ তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জামুকার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা নন এমনদের সনদ দেওয়ার উত্থিত অভিযোগ গুরুতর, এ অভিযোগের দ্রম্নত তদন্ত জরুরি। মুক্তিযোদ্ধা নন এমনদের জামুকা সনদ দেওয়ার অর্থ সরকার গঠিত কর্তৃপক্ষ জামুকার মাধ্যমে ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা তৈরি হয়েছে। যার দায় সরকারের ওপর বর্তায়। মুক্তিযোদ্ধা দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতীয় বীর। জাতীয় বীর নকল/ভুয়া হয় না, হতে পারে না। বিশ্বে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে নকল/ভুয়া জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বানানোর নজির রয়েছে। জাতির দুর্ভাগ্যই। বাংলাদেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর 'কারখানা' সচেতনভাবেই চালু করা হয়েছে স্বাধীনতার পরপর। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম সরকারের আমলে চালু হওয়া ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর 'কারখানা' পরবর্তী কোনো সরকারের আমলেই বন্ধ করা হয়নি, 'কারখানা'য় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা 'উৎপাদন'ও ব্যাহত হয়নি? ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর 'কারখানা'য় নিরবচ্ছিন্ন 'উৎপাদন'-এর ফলশ্রম্নতিতে দেশ ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধায় সয়লাব হয়ে গেছে। বর্তমানে নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বেরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
যে জাতি নকল/ভুয়া জাতীয় বীর (মুক্তিযোদ্ধা) বানায় সে জাতি জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মান-মর্যাদা উপলব্ধি করতে সক্ষম বলা যায় না। ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা নকল পণ্যের মতো গোপনে বানানো হচ্ছে না। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রকাশ্যেই বানানো হচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজতক প্রতিটি সরকারই নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোতে প্রতিটি সরকারের যুক্ততায় প্রমাণ করে, মুক্তিযোদ্ধার নিখাদ তালিকা তৈরির ইচ্ছা আগেও ছিল না, এখনো নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা/প্রণয়ন অসাধ্য বা কষ্টকর ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ চেইন অব কমান্ডের আওতায় বা অধীনে হয়েছে। চেইন অব কমান্ড খুবই সুশৃঙ্খল ছিল। গোটা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ১১টি সেক্টরের কোনো না কোনোটির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট হয়েছে নীতিমালা ও কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। রিক্রুটের পর অস্ত্র চালনা, বিস্ফোরক ব্যবহারসহ একজন রণযোদ্ধার যে ধরনের ট্রেনিং প্রয়োজন তা দেওয়া হয়েছে। রিক্রুট করা ব্যক্তিকে ট্রেনিং সমাপ্তির পর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে প্রেরণ করা হয়েছে, সেক্টর হেডকোয়ার্টার যাকে যেখানে প্রয়োজন সেখানে যুক্ত করেছে। এসবই করা হয়েছে কাগজ-কলমে। কারা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত তা বের করার জন্য গায়েবি শক্তির সাহায্য-সহায়তা প্রয়োজন পড়ে না। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গোলা-বারুদ, প্রয়োজনীয় রণসরঞ্জাম, রসদ, চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। অস্ত্র, রসদ, গোলা-বারুদ, প্রয়োজনীয় রণসরঞ্জাম, চিকিৎসা মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিশ্চিত হয়েই দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা নন এমনরা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগই থাকার কথা নয়। ভারত সরকারও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করেছে নিরাপত্তাসহ নানা কারণে। সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন সম্ভব ছিল। দু-এক জায়গায় ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে গঠিত বাহিনী স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে গঠিত বাহিনীর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল টাঙ্গাইলে আবদুল কাদের সিদ্দিকী গঠিত কাদেরিয়া বাহিনী, ফরিদপুরে হেমায়েত উদ্দীন গঠিত হেমায়ত বাহিনী। আরও দু-এক জায়গায় হয়ত এ ধরনের বাহিনী গঠন করে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা হয়েছে। এ সব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদেরও নির্ভুল তালিকা করা যেত এসব বাহিনী প্রধানদের সহায়তা নিয়ে। স্বাধীনতার পরপর চাইলে সহজেই মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা যেত। বলা অন্যায় হবে না যে, মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা তৈরির সদিচ্ছা শুরুতেই ছিল না। মুক্তিযোদ্ধার নিখাদ তালিকা সদিচ্ছার অভাবেই হয়নি। বর্তমান সরকারের আগের সরকারগুলোও মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রণয়নে আগ্রহী ছিল না। চলমান সরকারেরও আগ্রহ আছে মনে হয় না।
আওয়ামী জোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) গঠন করা হয়েছিল নির্মোহভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের কথা বলে।
জামুকাও নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অভিযোগে অভিযুক্ত হলো। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানো বন্ধ করতে হবে। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সঙ্গে যারা জড়িত/লিপ্ত তারা সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার মতো অপরাধ করেছেন বা করছেন। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোকে মুক্তিযুদ্ধদ্রোহী কর্মকান্ড গণ্য করে শাস্তি দেওয়াই যথার্থ হয়। ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, মুক্তিযোদ্ধাদের মান-মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের দলমতনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যজনক যে, হাতেগোনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এক সময়কার চেয়ারম্যান সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. ক. (অব.) কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তমকে স্বাধীনতার পর থেকে আমৃতু্য ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ দেখা গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা যদি দলমতনির্বিশেষে ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বিরুদ্ধে শুরুতেই গর্জে উঠতেন তাহলে ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানো সম্ভবই হতো না। মুক্তিযোদ্ধাদের মানমর্যাদাহানি হচ্ছে ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় বীর, সর্বোচ্চ মর্যাদা তাদের প্রাপ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের উচিত ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানো বন্ধ এবং ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য দলমতনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হওয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদেরও এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া দরকার। জাতীয় বীর নকল/ভুয়া হতে পারে না। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানো বন্ধ, ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করে বাদ দেওয়া, ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সঙ্গে জড়িত এবং ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন যারা তাদের শাস্তির জোর দাবি সব মহল থেকেই ওঠা উচিত।
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক