মেধাবীরা দেশের অমূল্য সম্পদ
দুষ্কৃতকারীরা দেশের যে সমস্ত মূল্যবান সম্পদগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে তা সত্যিই অমানবিক। এরা মানুষ নয়, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ করেছে। এদের শাস্তি চায় দেশের মানুষ।
প্রকাশ | ৩০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বিপস্নব বড়ুয়া
মেধাবী সন্তানরা হচ্ছে দেশের অমূল্য সম্পদ। দেশের সম্পদ দেশে থাকবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু অধিকাংশ মেধাবীরা দেশে চাকরি না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে- এ দৃশ্য অন্তত ৪০ বছরের। এভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের মেধাবীরা। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তাদের মেধার উদ্ভাবনী যত প্রকল্প। অন্যদিকে, দীর্ঘশ্রমের বিনিময়ে সন্তানদের গড়ে তোলার পর জীবনের শেষ সীমানায় এসে সেই পিতামাতারা হয়ে পড়ছে নিঃস্ব। দেশে চাকরি স্বল্পতায় পিতামাতার আরাধ্য সন্তানরা বাধ্য হয়ে পাড়ি জমান প্রবাসে। প্রবাসে গিয়ে এক সময় তাদের মতো করে সংসার-আবাসস্থল গড়ে তোলে আর এদিকে গর্বজাত মা-বাবারা সন্তানের শোকে শোকে পাথর হয়ে চলে যাচ্ছে শেষ ঠিকানায়। এই চিত্রটি এখন বাংলাদেশে অহরহ। ১৯৭১ সালে শত্রম্নর বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করে স্বাধীনতার সূর্য যারা উদিত করেছিল সেই সব অকুতোভয় সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির গৌরবীয় সন্তান। তাদের হাত ধরে বাঙালি জাতি আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বসবাসের সুযোগ লাভ করেছে। যতটুকু জানি, বীর মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জন্যও সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করণীয় করুক, এতে কারো কোনোরকম মাথাব্যথা নেই। দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে অমর্যদার আঙুল তোলাও আমি মনে করি ঘোর অন্যায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ে যখন বংশপরম্পরা কোটা সুবিধা নিতে চায় তাহলে, আজ না হয় কাল কেউ না কেউ কথা বলবেই। মনে রাখতে হবে, অধিকার নিজে থেকে অর্জন করে নেওয়ার মধ্যে যে রকম আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। কারো দয়ায় পাওয়ার মধ্যে সে রকম তৃপ্তি নেই। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া দেশের মেধাবী সন্তানরা কোটাপ্রথা সংস্কার নিয়ে গড়ে তোলেন তীব্র আন্দোলন। আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দুষ্কৃৃতকারীগোষ্ঠী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ব্যাপকহারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বিনষ্ট করে দেয় মূল্যবান সম্পদ।
কোটার বিষয়টি আজকের নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে কোটা ব্যবস্থা চালু ছিল। দেশের সরকারি চাকরিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত কোটায় ৮০ শতাংশ, মেধায় ২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে সংস্কার করে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত কোটায় ৬০ শতাংশ, মেধায় ৪০ শতাংশ। ১৯৮৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত কোটায় ৪৪ শতাংশ, মেধায় ৫৬ শতাংশ। তবে এই সময়ে এসে দেখা যায় কোটাকে আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০, জেলা কোটা ১০, নারী কোটা ১০, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা ৫ ও প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ হারে বণ্টন করা হয় (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব ২০ জুলাই)। ২০১৮ সালে ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকার আংশিক সংস্কার এনে পরিপত্র জারি করে যেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা তুলে নেন। এরপর সরকারের জারি করা পরিপত্রের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেন কোটা বঞ্চিতরা। সেই রিটের শুনানি শেষে চলতি বছর ২০২৪ সালের ৫ জুন এক রায়ে ২০১৮ সালে দেওয়া রায়কে আদালত অবৈধ ঘোষণা করার ফলে পূর্বের মতো ৫৬ শতাংশ কোটা বলবৎ হয়ে যায়। এই রায়ের পর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়। এরপর থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দেন।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, প্রতিটি সরকারের আমলে কোটাপ্রথা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫৪ বছর। এই ৫৪ বছর কমবেশি দেশের কিছু মানুষ কোটা সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু বর্তমান এমন একটি সময় যেখানে শিক্ষার্থীদের বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয় সেখানে এ ব্যবস্থা কতটুকু যৌক্তিক? যা হোক, দেশব্যাপী বহু অঘটনের পর সমগ্র জাতির দৃষ্টি ছিল হাইকোর্টের রায়ের দিকে। অবশেষে ২১ জুলাই (২০২৪) উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে আগের দেওয়া রায় বাতিল করে নতুন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মেধা কোটায় ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ শতাংশ, উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য ১ শতাংশ কোটা বণ্টনের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করলে ছাত্ররা রায়কে স্বাগত জানান। এবং রায় ঘোষণার দুইদিনের মাথায় ২৩ জুলাই সরকার এই রায়ের ওপর প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারের এটিও একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কোটার বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয় তাই, কোনো সরকারই এটি নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমম্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুলস্নাহ এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম ১৯ জুলাই গভীররাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (শিক্ষামন্ত্রী), আনিসুল হক (আইনমন্ত্রী), মোহাম্মদ আলী আরাফাতে (তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী)-র সঙ্গে দেখা করে তাদের ৮ দফা দাবি পেশ ধরেন। আপাতত ১টি দাবি পূরণ হয়েছে, তাদের বাকি দাবিগুলোর মধ্যে আছে- নিহতদের ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে গ্রেপ্তার, বিচার ও শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা, মাসিক ভাতা ও তাদের পিতামাতার মতামতের ভিত্তিতে একজনকে চাকরি, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ, সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করা, ছাত্র সংসদ চালু করা, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা সব মামলা প্রত্যাহার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষার্থীকে সব ধরনের রাজনৈতিক, আইনি বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক একাডেমিক হয়রানি না করার নিশ্চয়তা। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ছাত্রদের এই দাবিগুলোও বাস্তবায়ন করবেন বলে আশা করছি।
আজকে ধরুন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবার পরিজন নিয়ে এ দেশের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করলেন। চাইলে, তার বংশধররা কোনোরকম কাজ ছাড়াই দেশে বা বিদেশে বসে দিব্যি আয়েশে জীবনযাপন করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে জাতির জনকের কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার মতো মৃতু্যকে মাথায় নিয়ে বিদেশের আরামের স্থান ফেলে বাঙালি জাতির অধিকারের জন্য দেশে ফিরে এসে আন্দোলন সংগ্রাম, কারাবরণ করে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন আর সেই ভোটারদের দেওয়া ভোটেই তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়েছেন। তিনি আজ এতটুকু এসেছেন শুধুমাত্র পিতার কারণে নয়, এর জন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। আজকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর আছেন আপনারা প্রধানমন্ত্রীর আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন। দেখবেন আত্মমর্যাদা আত্মসন্তুষ্টি নিয়ে সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা বলি, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের পরিবারে শত শত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। আমার মা-বাবা, জেঠুরা জীবন বাজি রেখে তাদের খাবার-দাবার থেকে শুরু করে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিবাহিনীদের রান্না করে খাবার প্রদান করেছে। তখন আমি ছোট্ট শিশু। আমার মা-জেঠিরা খাবারের জোগান দিতে গিয়ে আমি এবং আমার অন্যান্য ভাইদের নাকি বাড়িতে আশ্রিতাদের কোলেপিঠে চড়ে বড় হতে হয়েছে। তাই আমি মনে করি, আমার কাছে আমার মা-বাবা-জেঠু-জেঠিরা একেকজন সার্থক বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহসী সৈনিক। এটি আমার কাছে বড়ো অহংকারের পরিচয়। চাইলে, আমার মা-বাবারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান পেতে পারতেন। সার্টিফিকেটের পেছনে না দৌড়ানোর কারণে সে স্বীকৃতি মা-বাবাদের কপোলে জোটেনি। তারপরও বলব মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি জাতির গৌরবের অংশীদার। তাদের সম্মান জানানো নৈতিক দায়িত্ব। সে যেই হোক, কোটা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে দেশে তান্ডব চালানোকে কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না।
দুষ্কৃতকারীরা দেশের যে সমস্ত মূল্যবান সম্পদগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে তা সত্যিই অমানবিক। এরা মানুষ নয়, পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট আচরণ করেছে। এদের শাস্তি চায় দেশের মানুষ।
বিপস্নব বড়ুয়া : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক