বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে এখন ভিন্নখাতে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিষয়টি অতিরঞ্জিত করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলে মেরুকরণের বিষয়টিও আমরা লক্ষ্য করছি। সরকারের বিরুদ্ধে একটি চাপ সৃষ্টির চেষ্টা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। আর এসব লবিংয়ে নিয়োজিত রয়েছে কোটা আন্দোলনের পেছনে লুকিয়ে থাকা নীলনকশা প্রণয়নকারীরা। ইতোমধ্যেই ড. মুহম্মদ ইউনূস ভারতের দি হিন্দু পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এমনকি তিনি বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন- এমন বিষয়টিও সেখানে উলেস্নখ করেছেন ওই সাক্ষাৎকারে। ড. ইউনূসের বক্তব্যে বেশ কিছু মনগড়া ব্যাখ্যা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। অথচ এর প্রেক্ষাপটটি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা না করলে- সেটি যথাযথ হবে না। একটি ঘটনার পেছনের ঘটনা থাকে। আর সেটির ব্যাখ্যা না দিয়ে পরের ঘটনা ব্যাখ্যা করার বিষয়টি কোনোভাইে ন্যায্য নয়। কারণ কোনো একটি ঘটনা এমনিতেই সৃষ্টি হয় না। আর কোনো একটি অরাজনৈতিক ইসু্যকে যখন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা তখন তা নিশ্চয়ই কল্যাণকর হয় না। কোটা সংস্কার ইসু্যটি আদালতে বিচারাধীন থাকা সত্ত্বেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চলমান রেখেছিল। এমনকি আন্দোলনকারীরা দ্রম্নত কোটা সমস্যার সমাধান করতে সরকারকে চাপ দিতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে এবং আন্দোলনকারীদের আদালতের রায় পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে আহ্বান জানানো হয়। এর পরেই সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের অবস্থানকে ঘিরে বেশ কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছিল- তারা হঠাৎ করেই প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের রাজাকার দাবি করে মধ্যরাতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অথচ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কোনোভাবেই আন্দোলনকারীদের রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়নি। এর পরপরই বেশ কিছু ভুল বুঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পরিস্থিতি আন্দোলনকারীদের পক্ষে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এরপরও আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দিতে একটি কুচক্রী মহল ষড়যন্ত্র করে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চেষ্টা করে। সারাদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ষড়যন্ত্রকারীদের হামলায় ভয়াবহ তান্ডব চালানো হয়। এমনকি এর পর পরই সরকার পতনের দাবিও উত্থাপিত হয়। উলেস্নখ্য, ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কোটা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হয়েছে। সরকার আন্দোলকারীদের সব দাবি মেনে নেয়া সত্ত্বেও আন্দোলকারীদের একটি অংশ সারাদেশে কমপিস্নট শাটডাউন চলমান ছিল। এরপর প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন দাবি নিয়ে তারা সামনে আসছে। একটি পর্যায়ে কোটা আন্দোলনকে পুঁজি করে দেশের উন্নয়নের প্রতীকে আঘাত হেনে দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তোলা হয়। নানা ধরনের জানমালের ক্ষতি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও আক্রমণ চালানো হয়। সারাদেশের্ যাব-পুলিশের অনেকের ওপরই নির্মমভাবে হামলা এবং হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এমন পর্যায়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় দুর্বৃত্তদের। এ অবস্থায় হতাহতের ঘটনা বেড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যখন চরম অবনিতি হয় তখন সরকার বাধ্য হয়ে সেনা মোতায়েন এবং কারফিউয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মূলত সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। দেশের জনগণের জানমাল দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প সরকারের হাতে ছিল না- এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। সেনা মোতায়েন এবং কারফিউ দেয়ার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই স্বাভাবিক হয়েছে। কাজেই সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত এবং হতাহতের ঘটনা কোনো ইচ্ছাকৃত বিষয় নয়। যারা নিহত হয়েছেন তাদের জন্য সরকার যথেষ্ট আন্তরিক হয়েছেন। সরকার কোনোভাবেই চায়নি যে দেশের মানুষের জীবনের বিনিময়ে কোনো সমস্যার সমাধান হোক। পরিস্থিতির কারণে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এর জন্য শুধু সরকার দায়ী নয়। ষড়যন্ত্রকারীরা কোটা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত না করলে এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে পড়তে হতো না। এমনকি সরকারকেও এমন হার্ডলাইনে যেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। একটি প্রায় সমাধান হওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের কুচক্রে পড়েই ঘোলাটে হয়েছে- সেটি সবাই অনুমান করতে পারে। কাজেই বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করলে পরিষ্কার হয়, যে কোনোভাবেই সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু একটি মহল ক্রমেই বিষয়টিকে রাজনৈতিক খাতে ব্যবহার করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বলা যেতে পারে, বিদেশিদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাই তাদের অন্যতম লক্ষ। যখন ভয়াবহ হামলা ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে- তখন সেটি দেখে আর কারও বুঝতে বাকি থাকেনি যে ওই হামলা এবং তান্ডব সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হয়েছে। বিশেষ করে ওই সময়ের পরিস্থিতি দেখে অনুমান করা যাচ্ছিল যে, একটি মহল চেয়েছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলন ইসু্যতে পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠুক। আর যত সংকটপূর্ণ হবে ততই সাধারণ জনগণকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করানো সম্ভব হবে। ড. ইউনূস দি হিন্দু পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে দেশে একটি নতুন নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করেছেন। এমন দাবি কোনোভাবেই ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা জানি, এ বছরেই ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যে নির্বাচনটি ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃত বিবেচিত হয়েছে। ওই নির্বাচনে দেশের বেশ কিছু দল অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি বিএনপি এবং তাদের শরিক দলগুলো নির্বাচনকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপরেও প্রায় ৪২ ভাগ ভোটার নির্বাচনে ভোট প্রদান করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে টানা চতুর্থবারের মতো ম্যান্ডেট দেয়। দীর্ঘদিন ক্ষতায় না থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত এখন আন্তর্জাতিক লবিং করছে। এর আগেও ২০২২-২৩ সালে তারা এমন লবিং অব্যাহত রেখেছিল। এবার যারা কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তারা। তাদের মূল লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করা। ইতোমধ্যেই বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে নানারকম নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল বিশেষ করে ড. ইউনূসের মতো সুশীল সমাজের সদস্যরা যারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করা চলে, তারা এই লবিংগুলো করছে। সরকারের ওপর ড. ইউনূস নানা কারণে বিরাগভাজন রয়েছেন। আর এ জন্য বর্তমান ইসু্যতে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। এমনকি এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী গণমাধ্যমকে কাজে লাগানোর অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। দেশের অভ্যন্তরীণ ইসু্যতে এভাবে বিদেশিদের কাছে ধরণা দেয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানই নয়। দেশকে বিদেশিদের হাতের পুতুল বানানোর অপচেষ্টা কোনোভাইে দেশবাসীর জন্য মঙ্গলজনক নয়। ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়