বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

নাশকতাকারীরা চিহ্নিত হোক

রাষ্ট্রীয় সম্পদ দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। এ সম্পদকে যারা ধ্বংস করতে চায় তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা প্রয়োজন।
মো. সাখাওয়াত হোসেন
  ২৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
নাশকতাকারীরা চিহ্নিত হোক

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত ও ১ হাজার ১১৭ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩২ জন গুরুতর আহত, ৩ জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি। দায়িত্ব পালনে পুলিশ সদস্যরা হামলার শিকার হয়ে কেউ মৃতু্যবরণ করেছেন, কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ জীবন মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, যারা নাশকতা করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে, তারাই পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছে, থানায় হামলা চালিয়েছে, কারাগার লুট করে জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কারাগারে হামলাকারীরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনতাই করে ওইসব সরঞ্জামাদি দিয়ে পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, নাশকতা সৃষ্টিকারীরা দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল এবং কোটা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তাদের গৃহীত পরিকল্পনা মোতাবেক রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর আঘাত হেনেছে এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছে।

কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সারাদেশে সহিংসতার যে আলামত দেখা দিয়েছে সেটি নজিরবিহীন। ঢাকা শহরে নাশকতাকারীরা তান্ডবলীলা চালিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের ভয়াবহ সহিংস আচরণের চিত্র খুব কমই দেখা গেছে। খবরে জানা যায়, বিদু্যৎ খাতের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের কারণে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সরকারি অসংখ্য স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সাম্প্রতিক সহিংসতা ও সংঘর্ষকে ঘিরে পুলিশের আইজিপি বলেছেন, কোটা আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন বিশৃঙ্খলা তৈরি করে সরকার হটাতে দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য ও পরিচয় দিলে উপযুক্ত পুরস্কার দেওয়া হবে। পুলিশ প্রধানের এ আহ্বান বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক। যারা রাষ্ট্রীয় স্থাপনার ক্ষতি করেছে, সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, মানুষের মাঝে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে, গাড়িতে আগুন দিয়ে পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, রক্তপাত ঘটিয়েছে তারাই নাশকতা সৃষ্টিকারী। নাশকতা সৃষ্টিকারীরাই দুর্বৃত্তায়নের রাস্তা তৈরি করেছে, এদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হবে।

পূর্বের সহিংসতা দেখলে দেখা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আগুন সন্ত্রাসের যে দৌরাত্ম্য পরিলক্ষিত হয়েছিল, কোটা আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতা পূর্বের অস্থিরতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরাতে জানা যায়, পেট্রোল বোমায় যারা অংশ নিয়েছে তাদের বিকাশে নগদে ও রকেটে পেমেন্ট করা হতো। এই টাকার জোগান দিত নির্দেশদাতারা, পরিকল্পনাকারীরা। বর্তমান সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, সহিংসতা সৃষ্টিকারীরা কারো না কারও মদতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সুনির্দিষ্ট টার্গেটে হামলা চালিয়েছে। বিআরটিএ ভবন লুট করে আগুন লাগিয়েছে। ঘটনাগুলোতে যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের বরাতে জানা যায়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়নি। হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব আমাদের সবার। তাদের পরিচয় জানা মাত্রই কিংবা দেখামাত্রই নিকটস্থ পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে।

তদন্তের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঘটনার সত্যানুসন্ধান নিশ্চিত করা। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সব সহিংসতার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের শনাক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে তদন্তের সীমাবদ্ধতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অপ্রতুলতা। এছাড়া ক্রাইম সিন এরিয়াকে যথার্থভাবে সংরক্ষণের অভাবে আলামত নষ্ট হয়ে পড়ে। এ বিষয়গুলোতে জনসাধারণের একাগ্রতা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন রয়েছে। আলামতের বিষয়ে পুলিশকে অবহিত করতে হবে। প্রয়োজনসাপেক্ষে ঘটনার সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত হয়ে ঘটনার সত্যতা নির্ণয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করে রাষ্ট্রের কাছে সোপর্দ করতে হবে।

দুর্বৃত্তায়নকারীরা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হানে এমন কর্মকান্ডসমূহ সন্ত্রাসী আচরণ। এ প্রেক্ষাপটে নাশকতাকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করে সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ অনুসারে তাদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুষ্কৃতকারীদের জানাতে হবে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র প্রতিহতে রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বোচ্চ ভূমিকা পালনে বদ্ধপরিকর। সাধারণ জনতাকেও নিশ্চিত করতে হবে, রাষ্ট্রের ওপর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালনাকারীগোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারে সবাই সহযোগিতা করবে। এ রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থার ওপর আগামীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। কাজেই যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করতে চায়, অর্থনৈতিক কাঠামোকে দোদুল্যমান অবস্থায় পর্যবসিত করতে চায়, বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা বাড়াতে চায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য দ্রম্নত ব্যবস্থা গ্রহণই পারে চলমান পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে। আবার যারা মুখোশ এঁটে গোপনে নাশকতাকারীদের অব্যাহত সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে তাদেরও শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। অর্থাৎ নাশকতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

জনতার মোবাইল ফোনের ভিডিও, অফিস আদালত ও বাসা বাড়ির সিসি ক্যামেরা, ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। কাজেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে এসব ডকুমেন্টস পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, আহত হয়েছেন তাদের কাছ থেকে সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমেও অপরাধীদের শনাক্তকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ সংক্রান্তে সব দায় শৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর না দিয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ ব্যতীত নাশকতাকারীদের শনাক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, এরা রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। এদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া যাবে না। একজন প্রকল্প বিশেষজ্ঞের বরাতে জানা যায়, সহিংসতায় দেশে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এ ক্ষতিপূরণ কীভাবে সম্ভব, রাষ্ট্র কীভাবে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে? মেট্রোরেলের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি মেরামত করতেও ১ বছর সময় লেগে যাবে। তাছাড়া ইউরোপ জাপান থেকে মেট্রোরেলের সরঞ্জামাদি আমদানি করতে হবে, ব্যাপক টাকা গুনতে হবে বাংলাদেশকে।

পরিশেষে উলেস্নখ করা যায়, নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে আনার দরকার নেই। এদের একমাত্র পরিচয় এরা নাশকতাকারী, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অনিষ্টকারী। নাশকতাকারী মানেই ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনাকারী যারা রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা ধ্বংস করে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাব বিভিন্ন সেক্টরে দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কাঠামোতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে, এর দায় নাশকতাকারীদের। এরা মহাখালীর ডাটা সেন্টারে আগুন লাগিয়ে ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে বিকল করে দিয়েছে। ইন্টারনেট না থাকায় বিদু্যৎ, গ্যাস, পানির বিল প্রদানে সমস্যায় পড়েছে জনগণ। তাছাড়া বিকাশ, নগদ, রকেট ও অনলাইন ব্যাংকিং সেবাও ইন্টারনেট বন্ধের কারণে সাময়িক বন্ধ রয়েছে। কাজেই, সামাজিকভাবে দুষ্কৃতকারীদের বয়কট করতে হবে। কেবল সামাজিক আন্দোলনই পারে সামাজিক অনিয়ম, অনাচার ও বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে। বাংলাদেশের প্রতিটি সমাজে একটি পরিকল্পিত সামাজিক কাঠামো বিনির্মাণ করতে হবে যেখানে অপরাধীদের কোনো জায়গা হবে না, অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় আইনে বিচারের মুখোমুখি করতে সমাজই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এমন ব্যবস্থা বিনির্মাণ করতে পারলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত রাখা যাবে।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। এ সম্পদকে যারা ধ্বংস করতে চায় তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা প্রয়োজন।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে