'ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর, তখনো জাগিনি যখন জোহর, হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর, মাগরিবের আজ শুনি আজান। জামাতে শামিল হওরে এশাতে, এখনো জমাতে আছে স্থান।' কী সুন্দর চমৎকার উপমা দিয়ে আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি চিরকাল অলসতাকে ঠেলে দিয়ে এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি বলে চেতনা ও জাগরণের সম্ভাবনার জয়গান গেয়েছেন। বৃক্ষরোপণ (লালন-পালনসহ) সবচেয়ে বড় সামাজিক বিপস্নব, মহৎকর্ম ও সাদকায়ে জারিয়াহ। বৃক্ষহীন স্থানই মরুভূমি, যেখানে বৃষ্টিপাত হয় না। সাম্প্রতিক সময় গাছপালা নিধনে দাবদাহে পুড়ছে সোনার বাংলা। কাঠফাটা রোদ, ভ্যাপসা গরম এবং সীমাহীন লোডশেডিংয়ে পশুপাখি, উদ্ভিদ, প্রাণী সবারই হাঁসফাঁস অবস্থা। ভয়ংকরভাবে বিপর্যস্ত আমাদের জনজীবন। কালো মানুষের কালো থাবায় সাদামনের মানুষরা কি বারবার হেরে যাবে? সাদামনের অধিকারীরা বা ভালো মানুষরা কেবলমাত্র ভালো কাজ করে আত্মতৃপ্তি পান। বিনিময় কি পেলেন বা না পেলেন সেটার তোয়াক্কা করেন না। সারাদেশে অনন্য রেকর্ড স্থাপনকারী ৭১ বছরের মুরুব্বি ইমাম ও পলস্নী চিকিৎসক খোরশেদ আলীকে দেখতে গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চিলারং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পাহাড়ভাংগা গ্রামে। তালগাছপ্রেমী বা পাগল এই মহান মানুষটি নিজের পৈতৃক পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করে অনেক দূরে গিয়ে তালের বীজ সংগ্রহ করে বিভিন্ন উপজেলা, বিভিন্ন স্থানে সড়কে ইতোমধ্যে ৫২ হাজার ৩০০টি তালের বীজ স্বহস্তে গভীর রাতে নিদ্রাহীন থেকে সেগুলো রোপণ করে পরিচর্যা করছেন। কেন রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সেগুলো লাগান, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন 'নানা বয়সি কিছু দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ তালের আঁটিগুলো খেয়ে ফেলে এবং গাছগুলো উপরে দেয়'। তার অদম্য ইচ্ছা হলো এক লাখ তালের চারা রোপণ করে বিশ্বের বুকে এক সোনালী ইতিহাসের গৌরব অর্জন করা। প্রকৃত পরিবেশ বন্ধু এই মহান লোকটিকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা, বুকভরা উজাড় করা ভালোবাসা। তার আবেগের মধ্যে মিশে আছে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর মায়া, মমতা। বিশ্ব কবির মতে, 'ন্যায়, নীতি ও সত্যতে অটল থাকার দৃশ্যমান বড্ড তালগাছ আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক।' কেননা, 'তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে, আবার সবগাছ ছাড়িয়ে, আকাশে উঁকি মারে।' কবি রজনীকান্ত সেনের মতে 'ঝুলন্ত তালগাছে শক্ত বাসা বুননে বাবুই পাখি পরিশ্রমী, প্রকৌশলী ও আত্মমর্যাদার আরেক প্রতিচ্ছবি।' শিশু মননের আলোড়িত ছড়া খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীনের 'ওই দেখা যায় তালগাছ, ওই আমাদের গাঁ...।' দৃশ্যমান উঁচু তালগাছ যেন আবহমানকালের গ্রাম বাংলার পরিচয়ের সাক্ষ্য দেয়। তক-বিতর্ক ও কথায় আমরা বলে থাকি 'বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার।' যাকে সহজভাবে জোর করে জিতে যাওয়া বলে। বহুমাত্রিকভাবে তালগাছ আমাদের বাংলা সাহিত্যে বিদ্যমান। বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বজ্রপাত) সারা বিশ্বে এক আতঙ্কের নাম। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো 'তালগাছ, সুপারিগাছ এবং নারিকেল গাছ ঝড়, তুফান, টর্নেডো, প্রবল হাওয়া প্রতিরোধ, মাটির ক্ষয়রোধে সহায়তার পাশাপাশি আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করে। এ ছাড়াও ভূমিধস, ভূমিক্ষয়, ভু-গর্ভস্থ পানির মজুত বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষায় তালগাছের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা, ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছ রোপণে প্রথমেই তা মাটির নিচে প্রবেশ করে। এর ফলে গাছটি ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। সবচেয়ে আনন্দদায়ক খবরটি হলো বজ্রপাত (বিদু্যৎ স্পর্শ) এর থাবা থেকে মানুষ, পশুপাখিসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই গাছ আমাদের অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধু। তালগাছ ৯০-১০০ ফুট উঁচু হওয়ায় এবং বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকায় আকাশের বিজলী গাছ হতে তা সরাসরি মাটিতে চলে যায়। বেশি বেশি তালগাছ থাকলে গ্রামীণ জনপদের কৃষক, শ্রমিক, জেলে ও মেহনতি ইত্যাদি মানুষরা মহাবিপদ থেকে রক্ষা পাবে। বজ্রপাত বাংলাদেশে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর এই আকস্মিক মৃতু্য, মৃতু্যর ঝুঁকি ও সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে। অনেক উপাকারী তালগাছের কান্ড, বাঁকল ও লতাপাতা। তালের কাঠ খুব শক্ত, মজবুত ও টেকসই। ঘরের খুঁটি আসবাবপত্র, বিভিন্ন গৃহস্থালী সামগ্রী ও আদি যানবাহন নৌকা তৈরিতে তালকাঠ অনন্য। লোকজ চিকিৎসায় তালের ব্যবহার প্রচুর। মানব শরীরের কোষের ক্ষয়রোধ করে এবং তারুণ্য ধরে রাখে তাল। এক কথায়, পুরো তালগাছটিই হরেক রকম কাজে ব্যবহার হয়। কোনো অংশই অপ্রয়োজনীয় নয়। পরিপক্ব একটি তালগাছ দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।পরোপকারী বৃক্ষ তালগাছ শাখা-প্রশাখাহীন একবীজপত্রী উদ্ভিদ। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় গাছেই ফুল হয়। ১২-১৩ বছর হলেই স্ত্রী গাছে ফল আসে। প্রচুর ভিটামিন ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ কাঁচা ও পাকা তাল সুস্বাদু ও মিষ্টি। একটানা ৯০-১২০ দিন পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১২-১৫ কেজি রস দেয়। পাঁচ কেজি রস থেকে এককেজি গুড় তৈরি হয়। তালগাছ ১৪০-১৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ভালো কাজে পুরস্কার ও মন্দ কাজে তিরস্কার সবারই করা উচিত। আজ দেশের আনাচে-কানাচে কিছু মহৎপ্রাণ ব্যক্তি, সংগঠন স্ব-উদ্যোগে যেভাবে তালগাছ বা অন্যগাছ লাগাচ্ছেন, সে কাজগুলোকে সরকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা উচিত। ছোট্ট আয়তনের এই দেশে সুষ্ঠু মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে সর্বত্র বিশেষ করে গ্রামীণ ও উপকূলীয় অঞ্চলে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। বিদু্যৎস্পর্শ থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের বিকল্প নেই। প্রতিটি সমস্যার সমাধান যুক্তিসঙ্গতভাবে বা মাঝে মাঝে অলৌকিকভাবে হয়ে থাকে। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যে কোনো সফলতা দ্রম্নত করা অসম্ভব নয়। তালগাছের সারি সারি নান্দনিক সৌন্দর্য রূপ দেখতে যেমন সুন্দও, ঠিক তেমনি রয়েছে এর বিভিন্ন রকম উপকারিতা। অশাল মৃতু্য থেকে দেশবাসী তালগাছের ছোঁয়ায় শুধু রক্ষাই পাবে না, সবুজ বেষ্টনিতে গড়ে উঠবে আমাদের গ্রাম বাংলার প্রতিটি গ্রামের কৃষি, অকৃষি ভূমি। একজন পরিবেশসচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মতো সবাই এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে চায়।
কায়ছার আলী
দিনাজপুর