জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানির দহন তথা কার্বন নিঃসরণ। ধরিত্রী রক্ষায় কার্বন নিঃসরণকে 'না' বলার বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে উন্নত দেশ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বিচারিতা মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে মুখে বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন পৃথিবীর জন্য হুমকিস্বরূপ অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এমনকি ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অঙ্গীকার মানার জন্য যেসব দেশ বা যারা একমত হয়েছিল তারাও এখন জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ আগের থেকে বাড়িয়ে দিয়েছে। জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল বিশ্বব্যাংক। জার্মানভিত্তিক পরিবেশবাদী গ্রম্নপ আর্জওয়ার্ল্ডের তথ্য বলছে, বিশ্বব্যাংক প্যারিস চুক্তির পর ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের বেশি জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ করেছে। যে বিশ্বব্যাংক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য ও বৈষম্য মোকাবিলায় কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে সেই বিশ্বব্যাংকের জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ আত্মঘাতী নয় কী?
১৯৯৭ সালে হওয়া কিয়োটা প্রটোকল চুক্তিতেও গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর প্রতিশ্রম্নতি থাকলেও তা পুরোপুরি মানেনি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। যদি তখন থেকে নবায়নযোগ্য সম্পদে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে আজকের অবস্থা দেখতে হতো না। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে কিছু কিছু দেশ আন্তরিক থাকলেও অধিকাংশ দেশ জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়িয়েই চলেছে। অথচ জলবায়ু চুক্তিতে বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো তারা নিজেদের মতো করে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে। এ শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে না দেওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে তা পূরণ সম্ভব হবে না। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে উপকূলীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জোট (এওএসআইএস) প্রতিটি 'কপ' সম্মেলনের আগে ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু বাস্তবে ক্ষতিপূরণ আদায় কার্যকর কোনো সমাধান নয়। একদিকে ধনী রাষ্ট্রগুলো কার্বন নিঃসরণ করতে থাকবে অপরদিকে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ পেতে থাকবে ঝুঁকির মুখে থাকা দরিদ্র দেশগুলো- এই নিয়ম দীর্ঘদিন চলতে থাকা মানে ধরিত্রীর সঙ্গে চরম অন্যায় করা। কেননা এই অসম ধারা চলতে থাকলে একটা সময় হয়তো সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো। কার্বন নিঃসরণকারী শীর্ষ দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও কানাডা। ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) জয়েন্ট রিসার্চ সেন্টার ও পিবিএল নেদারল্যান্ডস এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট এজেন্সির এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৪০ শতাংশ করে থাকে চীন ও আমেরিকা। এরপর এগিয়ে রয়েছে এশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধনী দেশগুলো। গবেষণায় বলা হয়েছে, চীন প্রতি বছর ১১ হাজার ২৫৬ মেগা টন (১ মেগা টন সমান ১০ লাখ টন) কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণ করে থাকে ৫ হাজার ২৭৫ মেগা টন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণ করে থাকে ৩ হাজার ৪৫৭ মেগা টন। ভারত প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণ করে থাকে ২ হাজার ৬২২ মেগা টনের বেশি। রাশিয়া ও জাপানের প্রতিবছর কার্বন নিঃসরণের হার প্রায় ২ হাজার মেগা টনের মতো। এটা পরিষ্কার, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে বিশ্বকে যেতেই হবে। কিন্তু দেখা যায় প্রতিটি 'কপ' সম্মেলনের আগে এই শিল্পোন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি চুপচাপ থাকে। চুপচাপ থাকলেই কী ধরিত্রী রক্ষা করা সম্ভব হবে? যেসব ধনী দেশ তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী তাদের হাতেই এখন ধরিত্রী রক্ষার চাবিকাঠি। কার্বন নিঃসরণকে গুডবাই বলার জন্য সবার আগে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্যারিস চুক্তিতে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কেননা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো মানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তিতে সে হারে বিনিয়োগ বাড়ছে না। তথ্য বলছে, বিশ্বের মোট শক্তি ব্যবহারের ৮০ শতাংশের বেশি আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। বড় বড় দেশের পরিবহণ খাত, বিদু্যৎ ও শিল্প খাত থেকে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে বন্যা, খরা, দাবানল, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। উভয় দিক দিয়ে শিল্পোন্নত দেশসমূহের পাশাপাশি সব রাষ্ট্রকেই ভুগতে হচ্ছে। জ্বালানি শক্তি বর্তমান পৃথিবীর চালিকাশক্তি। যেসব ধনী দেশ এখন নবায়নযোগ্য সম্পদে বিনিয়োগ করবে আগামী দিনের বৈশ্বিক জ্বালানি সমস্যা মোকাবিলায় সেসব দেশ অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবুজ গ্রহটিকে মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকান্ডে তিলে তিলে মেরে ফেলার কোনো অর্থই হয় না। প্রকৃতি সুরক্ষার দায় কারও একার নয়। বৈশ্বিক বাস্তবতায় একা চলারও সুযোগ নেই। প্রকৃতি সুরক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হবে। তাই ধরিত্রী রক্ষায় ও আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য কার্বন নিঃসরণকে 'না' বলতে হবে।
সাধন সরকার, ঢাকা