রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

পানিতে ডুবে শিশুর মৃতু্য একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

পানিতে ডুবে শিশুমৃতু্য নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অর্গানাইজেশন এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখা জরুরি।
প্রফেসর ড. মো. ইদ্রিস আলম
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
পানিতে ডুবে শিশুর মৃতু্য একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট

শিশু এবং কিশোরদের মৃতু্যর অন্যতম প্রধান কারণ হলো পানিতে ডুবে মৃতু্য- যা বর্তমানে একটি অবহেলিত জাতীয় সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) (২০১৯) সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে ২,৩৬,০০০ লোক পানিতে ডুবে মারা যায়- যার, ৯০ শতাংশ ঘটে নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশসমূহে। বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী ১-৪ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মারা যায় এবং দ্বিতীয় ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হলো ৫-৯ বছর। ডঐঙ (২০১৭) তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, পুরুষ বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার তুলনায় দ্বিগুণ পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে মৃতু্য পরিহারযোগ্য। তবে পানিতে ডুবে মৃতু্য পরিহারে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে অপেক্ষাকৃত কম।

বাংলাদশের প্রথম স্বাস্থ্য এবং তথ্য জরিপ (২০১৩) অনুযায়ী ১-১৭ বছরের শিশুদের অপমৃতু্যর প্রধান কারণ হলো পানিতে ডুবে মৃতু্য- যা যৌথভাবে নিউমোনিয়া, অপুষ্টি এবং কলেরা দ্বারা মৃতু্যর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য এবং তথ্য জরিপ (২০১৬) অনুযায়ী বছরে ১৪,৪৩৮ জন (১-১৭ বছর বয়সি) শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। শিশু মৃতু্যর অন্যতম প্রধান কারণ হলো-১. বয়স্কদের তত্ত্বাবধানের অভাব, ২. গ্রামে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের অভাব, ৩. অতি দারিদ্র্যতা, ৪. পুকুর-জলাধারে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাব এবং ৫. সাঁতার না জানা। বাংলাদেশে প্রায়শ ৮-৯ বছরের বাচ্চাদের সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। যদিও একটি সুস্থ বাচ্চাকে ৪-৫ বছর বয়স থেকে সাঁতার শিখানো উচিত। পুকুর, ডোবা, খাল, বালতি এবং বাকেট ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন বয়সি শিশুরা মারা যায়। হোসাইন এবং তার সহযোগীরা (২০২২) গবেষণায় দেখান যে, ৫ বছর বয়সিদের ৮০ শতাংশ পানিতে ডুবে মৃতু্য ঘটে বসতঘর থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে পুকুর-জলাশয়ে। বাংলাদেশে একাধিক শিশু বিশেষভাবে জোড়া শিশু একই স্থানে একই সঙ্গে পানিতে ডুবে মারা যেতে দেখা যায়। সাধারণত একটি শিশু অন্য শিশুকে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার সময় বাঁচাতে গিয়ে এক সঙ্গে মারা যায়। এতে বুঝা যায়, শিশুকে পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশল বিশেষত নিরাপদ উদ্ধার কৌশল সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় না।

ডিজাস্টার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (দাদু) কর্তৃক ২০০৪ সালে মার্চ মাসে সন্দ্বীপে এক জরিপে দেখা যায় যে, প্রতি ১০ পরিবারের মধ্যে অন্তত সাত পরিবারে কোনো না কোনো ধরনের পানিতে ডুবে মৃতু্যর ঘটনা ঘটেছে। জরিপের ফলাফলে বিশ্লেষণে আরও দেখা যায় যে, পানিতে ডুবার ঘটনার সময়কালে শিশুর মা কোনো না কোনো ধরনের পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ শিশুটি কোনো অভিভাবকের বড়দের তত্ত্বাবধানে ছিল না। মায়েদের কর্মব্যস্ত সময় বিশেষ করে সকাল ৯টা থেকে একটার মধ্যে শিশুদের একাকি খেলতে দেওয়া হয়। একইভাবে দাদু কর্তৃক রংপুরে আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের মৃতু্যর পূর্ববর্তী কার্যক্রম ছিল তারা খেলেছিল। খেলতে গিয়ে পানিতে ডুবে এই মৃতু্যকে পারিবারিকভাবে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সচেতনতার মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের ব্যস্ততার সময়ে শিশুরা এভাবে বাহিরে একাকি খেলতে গিয়ে মৃতু্য অবশ্যই পরিহার করা সম্ভব।

সচেতনতার অভাব, বয়স্কদের দ্বারা শিশু তত্ত্বাবধানের অভাব এবং অবহেলাকে পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্যর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ডঐঙ (২০১৭) পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণে ছয়টি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। যেমন-১. প্রাক স্কুল বয়সি শিশুদের পানি থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ, ২. পানিতে গমন পথে বেষ্টনী প্রদান, ৩. সাঁতার শিখানো এবং পানি থেকে নিরাপত্তা কৌশলে প্রশিক্ষণ প্রদান, ৪. বন্যা ও অন্যান্য পানি থেকে সংঘটিত দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা, ৫. পানি থেকে শিশুদের নিরাপদে উদ্ধার এবং সিপিআর প্রশিক্ষণ প্রদান ও ৬. বোট, জাহাজ এবং ফেরিতে নিরাপদে যাতায়াতে কার্যকরী বিধি ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠাকরণ। ওপরে উলিস্নখিত ছয়টি নিবারণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডঐঙ চারটি কৌশল প্রণয়নের সুপারিশ করে; যেমন- ১. বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকান্ডে সমন্বিতভাবে পানিতে ডুবে মৃতু্যর কথা বিবেচনা করা, ২. কৌশলগত যোগাযোগের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করা, ৩. তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং গবেষণার মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃতু্য নিবারণে সৃজনশীল কৌশল প্রণয়ন করা ও ৪. জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রণয়ন করা। ডঐঙ (২০১৭) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পানিতে ডুবে মৃতু্য হারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণসহ সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের কথা বলেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক পানিতে ডুবে মৃতু্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করছে। ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃতু্য সংশ্লিষ্ট মানবিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির দিক উলেস্নখ করে নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নের জন্য জোর দিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণে ডঐঙ বিশ্বব্যাপী পানিতে ডুবে মৃতু্য বিষয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্ব পানিতে ডুবে মৃতু্য পরিহার দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ডঐঙ জনস্বাস্থ্য কর্মসূচির আওতায় পানিতে ডুবে মৃতু্য পরিহার বিষয়ে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। ২০২৩ সালের পানিতে ডুবে মৃতু্য নিবারণ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- 'যে কেউই পানিতে ডুবে যেতে পারে, কারও ডুবে যাওয়াই কাম্য নয়।'

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জন স্বাস্থ্য ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট মৃতু্য মোকাবিলায় দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রস্তুতি এবং নিবারণমূলক কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে থাকলেও পানিতে ডুবে মৃতু্য বিষয়ে কার্যক্রম অত্যন্ত অপ্রতুল। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০০৬ এবং ২০১৩ সময়ে রায়গঞ্জ, শেরপুর এবং মনোহরদী উপজেলায় পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কমিউনিটি ডে কেয়ার সেন্টার (আঁচল) এবং সাঁতার প্রশিক্ষণকে কম খরচে পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণের কার্যকরী কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করছে। উপর্যুক্ত দু'টি নিবারণ কৌশলর সঙ্গে জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করলে আরও বেশি সুফল পাওয়া সম্ভব। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের পানিতে ডুবে মৃতু্য নিবারণে বাস্তবায়িত আরও একটি প্রকল্পে কোনো এলাকায় একই সঙ্গে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বাস্তবায়ন করলে শিশু মৃতু্য নিবারণে ভূমিকা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্য নীতিতে পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্যকেও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্র্ভুক্ত করে। শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃতু্যও বিবেচনা করলেও সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত।

ডিজাস্টার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (দাদু) পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জনসচেতনতা এবং মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সাঁতার প্রশিক্ষণ এবং জলাধার থেকে সুরক্ষা কৌশল শিখানো, অনিরাপদ জলাধারে বেষ্টনী প্রদান এবং কমিউনিটি ডে কেয়ার স্থাপনে কাজ করছে। অর্থ সংকট, বাস্তবায়নের সক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে ডঐঙ কর্তৃক প্রদানকৃত নিবারণ কৌশলকে দেশব্যাপী বাস্তবায়নে সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এমতাবস্থায়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণে ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আমরা সবাই শিশু মৃতু্য নিবারণে ভূমিকা পালন করতে পারি। যেমন- ১. শিক্ষা ঘর থেকে শুরু হয়- পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্যর বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করা, ২. বাড়িতে শিশু পানি থেকে নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ করা, ৩. পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্যর ভয়াবহতা পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করা, ৪. বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার আড্ডায় অন্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টি উপস্থাপন করা, ৫. প্রতিবেশীদের বাচ্চারা নিরাপদ কিনা পর্যবেক্ষণ করা, ৬. উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করা, ৭. জলাধারের পাশে বেষ্টনী প্রদানের ব্যবস্থা করা, ৮. নিজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা এবং অন্যকেও উৎসাহিত প্রদান, ৯. আর্থিক সক্ষমতা থাকলে দরিদ্র পরিবারকে বেষ্টনীযুক্ত খেলাঘর (চষধুঢ়বহ) প্রদান, ১০. শিশুদের সাঁতারের শিখানোর ব্যবস্থা করুন (একটি সুস্থ বাচ্চা ৪-৫ বছর বয়স থেকে সাঁতার শিখা শুরু করতে পারে), ১১. ইউটিউব এবং স্বীকৃত প্রশিক্ষণকারীর কাছ থেকে সিপিআর প্রশিক্ষণ, ১২. আপনার এলাকায় যুবকদের সমন্বয়ে ক্যাম্পেইন দল গঠন, ১৩. জাতীয় জনসচেতনতা ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ, ১৪. আপনার এলাকায় কমিউনিটি ডে-কেয়ারের সম্ভাব্যতা যাচাই করুন এবং পারলে বাস্তবায়ন করুন।

পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণে সরকারি ছাড়াও এনজিও, কমিউনিটি অর্গানাইজেশন এবং বেসরকারি খাতের কার্যক্রম এখনো সীমিত। পানিতে ডুবে শিশু মৃতু্য নিবারণ কৌশল বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ এবং অবদান রাখা জরুরি।

প্রফেসর ড. মো. ইদ্রিস আলম : ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে