রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে

বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ৩৫ দেশের একটি, এ বিষয়টি তারা গ্রহণ করতে পারছে না। মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, এ ব্যাপারটিও তারা মেনে নিতে পারছে না। আবার ভারতবিদ্বেষী একটা গোষ্ঠী বাংলাদেশে রয়েছে যারা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব সম্পর্ককে একপক্ষীয় হিসেবে দেখার চেষ্টা করে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন
  ২৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
অপরাজনীতি বন্ধ করতে হবে

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবেই। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা, শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থান, সামাজিক সুদৃঢ় অবস্থান, আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিতি, আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের অংশীদার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের যথার্থতা বজায় রাখা, পররাষ্ট্র ও কূটনীতির ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য অর্জন, মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন, বিদেশিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপক আগ্রহ ইত্যাদি কারণে বোঝা যায় বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনাপরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে আসে, শ্রীলংকাসহ অনেক রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ তার সুসংহত অর্থনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশ পৃথিবীর অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ৩৫টি দেশের একটি। তাছাড়া, মানব উন্নয়ন সূচকে সমকালীন অনেক রাষ্ট্র থেকে বহু সূচকে এগিয়ে আছে প্রিয় বাংলাদেশ। বিশ্ব মানবাধিকার ইসু্যতে বাংলাদেশ বরাবরই সোচ্চার। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় দায়িত্বশীল বক্তব্য উপস্থাপন করে বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে।

সর্বশেষ চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ফিলিস্তিনকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে। বিশ্ব পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক পস্ন্যাটফরমে বাংলাদেশ জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গঠিত তহবিল সংগ্রহ কমিটিতে নেতৃত্ব প্রদান করছে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রই বাংলাদেশের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়াও সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতিতে যোগ্যতার মাপকাটিতে বাংলাদেশ একটি মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কেবল তাই নয়, সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে এবং রূপকল্প-২০৪১ প্রণয়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমন্ডলে একটি উচ্চমার্গীয় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তদুপরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো বিদেশ সফর শেষ হলে প্রতিটি সফরকে ঘিরে ষড়যন্ত্রকারীদের কাছ থেকে কিংবা অপরাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের পক্ষ থেকে যে ধরনের মুখরোচক আলোচনা শোনা যায় সেসব আলোচনা সত্য হলে দেশের অগ্রযাত্রা মুখ থুবড়ে পড়ত। কিন্তু দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অবলম্বন করে দেশ সামনের দিকে অগ্রসরমাণ।

সমঝোতা স্মারক একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হয়ে থাকে। দুটো প্রতিষ্ঠান কিংবা দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার পূর্বে উভয়পক্ষের সুনির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে স্মারকে উলিস্নখিত খুঁটিনাটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত গ্রহণ করে সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয় এবং স্বাভাবিকভাবে স্মারকে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করা হয়। স্বার্থ রক্ষা ব্যতীত সমঝোতা হয় কীভাবে? এক পক্ষীয় স্বার্থ বিবেচনায় কখনোই স্মারক স্বাক্ষরিত হয় না। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্প্রতি সম্পাদিত স্মারক নিয়ে আওয়ামী বিরোধী জোট বাংলাদেশে বিভিন্ন মুখরোচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অবশ্য এ সব আলোচনা এবারই নতুন নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে ঘিরে সব সময়ই বিরোধী পক্ষরা তীর্যক মন্তব্য করেছে, যা কোনোভাবে রাজনীতি সচেতন মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশবিরোধী একটি জোট সব সময়ই দেশবিরোধী নেতিবাচক প্রচারণায় লিপ্ত। ইতিবাচক কাজের মধ্যেও তারা সব সময় নেতিবাচক মন্তব্য করার ক্ষেত্রে তৎপরতা দেখায়। তাদের কাজই হচ্ছে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে একটি ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে হাঁটা।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ফলাফল হিসেবে দুই দেশের মধ্যকার বিভিন্ন সমঝোতা ও ঘোষণার কথা উলেস্নখ করা হয়। উলিস্নখিত বিষয়সমূহ হচ্ছে : বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য ই-ভিসা, রংপুরে ভারতের নতুন সহকারী হাইকমিশন স্থাপন, রাজশাহী এবং কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন পরিষেবা চালু করা, চট্টগ্রাম এবং কলকাতার মধ্যে নতুন বাস পরিষেবা চালু করা, গেদে-দর্শনা এবং হলদিবাড়ী-চিলাহাটির হয়ে ডালগাঁও পর্যন্ত মালবাহী রেল পরিষেবা চালু, অনুদান সহায়তায় সিরাজগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) নির্মাণ।

এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এসব বৈঠকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও কানেক্টিভিটি, অভিন্ন নদী, বিদু্যৎ ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক এবং নাগরিক পর্যায়ের যোগাযোগ বিষয়ে আলোচনা হয়। উভয় নেতাই স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে 'ভিশন ২০৪১' এবং ভারতের 'বিকশিত ভারত' অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান। এছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, স্পেস টেকনোলজি, সবুজ জ্বালানি ও সুনীল অর্থনীতির মতো নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণের বিষয়েও তারা একমত হয়েছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বর্তমান সম্প্রসারণমুখী প্রবণতায় দুই নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং এর পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টিও তারা উলেস্নখ করেন। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো খাদ্যপণ্যের অনুমানযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়। কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্টের (সেপা) আলোচনার দ্রম্নত সমাধান দুই দেশের বাণিজ্য খাতে চলমান সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে আরও এগিয়ে নেবে। কাজেই সমঝোতা স্মারক নিয়ে অপরাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই- তদুপরি একটি পক্ষ সরকারের ইতিবাচক কর্মকান্ডকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপনের নিমিত্তে তৎপরতা দেখিয়ে চলছে।

আমাদের মধ্যে একটি সমস্যা ব্যাপকভাবে প্রভূত হয়েছে- যেখানে দেখা যায়, মিথ্যার ওপর বিশ্বাসের সংস্কৃতি। অর্থাৎ একটি মিথ্যা গল্পকে এমনভাবে প্রচার করা হয় যেখানে মিথ্যকেই অনেকেই সত্য হিসেবে ধরে নেয়। এ জায়গাটিকেই অনেকেই কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ গ্রহণ করছে। ইন্টারনেটের যুগে বসেও যদি গুজব ও মিথ্যকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়ে কোনো একটি ঘটনাকে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে প্রকৃত সত্য আড়ালেই থেকে যায়। ভারত-বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সমঝোতা আদতে কীসের ওপর ভিত্তি করে হয়েছে কিংবা সমঝোতা স্মারকে কি কি বিষয় জায়গা পেয়েছে সে সবের প্রকৃত কারণ জেনে বুঝে মন্তব্য প্রদান করা উচিত। অবশ্য পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার রাজনীতি যারা করছে তাদের মিথ্যার ওপরও ভরসা করতে হবে। তবে রাজনৈতিক মঞ্চে ওঠে বক্তব্য দিলেই, মিডিয়ায় প্রচার হলেই কি সেসব জনগণ গ্রহণ করে? জনগণ কিন্তু গ্রহণ করছে না, জনগণ পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় সচেতন ও আধুনিক। তারা সমঝোতা স্মারকের সবগুলো বিষয় জেনে বুঝেই হিসাব-নিকাশ করবে। আবার এটিও সত্য যে রাজনৈতিক মঞ্চের রাজনৈতিক বক্তৃতাকে অনেকেই গ্রহণ করছে। আবার একটি পক্ষই রয়েছে যারা সরকারের সবসময় বিরোধিতা করবে। তাদের দৃষ্টিতে সরকারের যাবতীয় কাজই দেশবিরোধী, বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ৩৫ দেশের একটি, এ বিষয়টি তারা গ্রহণ করতে পারছে না। মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, এ ব্যাপারটিও তারা মেনে নিতে পারছে না। আবার ভারতবিদ্বেষী একটা গোষ্ঠী বাংলাদেশে রয়েছে যারা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সব সম্পর্ককে একপক্ষীয় হিসেবে দেখার চেষ্টা করে।

তবে মূল বিষয় হচ্ছে, সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে ভালো করে জেনে, চুক্তিকে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, কোনো দেশের স্বার্থ কীভাবে দেখা হয়েছে সবকিছু জেনে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মন্তব্য করা উচিত। অবিবেচকের মতো মন্তব্য দল ও ব্যক্তিকে জনগণের কাছে খাটো করে থাকে, ভোটের রাজনীতিতে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তোলে দল ও ব্যক্তিদের। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির মাধ্যমে সমঝোতা স্মারকের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে এবং দেখা যাচ্ছে স্মারকে দুই দেশের স্বার্থই প্রতিফলিত হয়েছে। কাজেই এ বিষয়টি নিয়ে অপরাজনীতির আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ নেই।

মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে