বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক একটি দেশ স্থান পায় বিশ্বের মানচিত্রে। সৃষ্টির পর থেকেই নতুন যাত্রা ছিল নানাভাবে কণ্টকাকীর্ণ, প্রতিকূল ও বিপৎসংকুল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা ও ভৌত-অবকাঠামো প্রায় সবকিছুই ছিল ভঙ্গুর প্রকৃতির। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্র্নির্মাণ করা নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের জন্য ছিল খুবই কঠিন চ্যালেঞ্জ, যা মোকাবিলা করার জন্য কাজ করতে হয়েছে পুরো দেশকে। এরপর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ উন্নয়নের মুখ দেখতে শুরু করে। নানা ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের পেছনে মূল বিষয় হলো বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান। আয়তনে বাংলাদেশ ছোট একটি রাষ্ট্র হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় বহন করে থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারতের অবস্থান। তাছাড়াও বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ৩টি জেলার সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তে চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর (২০-৬০ কি. মি.) রয়েছে, যা ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভারতের মূল ভূখন্ডের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী প্রধান কেন্দ্র। আবার এদিকে এটি চীনের সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে চীনও প্রভাব বিস্তার করতে চায় যদিও চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক মিত্রও বটে। কেননা, বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড ব্যবহার করেই উত্তর-পূর্ব ভারত এবং ভারতের মূল ভূখন্ডকে বৃহত্তরভাবে একত্রীকরণ সম্ভব। বর্তমানে ভারত বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল তথা সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পন্ন করে থাকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেরই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপ এবং উক্ত বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই দেশই একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্র রূপে কাজ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ভালো কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশ প্রধানত ভারতে গার্মেন্টস, টেক্সাইল, সামুদ্রিক খাবার এবং কৃষি পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে ভারত বাংলাদেশে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক, লোহা এবং ইস্পাত রপ্তানি করে। দক্ষ জনশক্তি ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একত্র হয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারত। তাছাড়াও বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে ভারত থেকে। ভারতের সঙ্গে পালস্না দিয়ে চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে আসছে বলেই চীন বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক বেশি। বাংলাদেশে চীন থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য সামগ্রী আমদানির বিপরীতে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রনীতি হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত অপর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও আচরণের নীতিমালা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশ 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়' (ঋৎরবহফংযরঢ় :ড় ধষষ, সধষরপব :ড় হড়হব), এই নীতি অনুসরণ করে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যার ফলশ্রম্নতিতে চীন ও ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ও বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলের দু'টি দেশ নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে নেপাল, ভুটান বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পারস্পারিক সম্প্র্রীতি, চুক্তি, বোঝাপড়া এবং জনগণের অভিন্ন মূল্যবোধ ও আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চিহ্নিত। নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশর অভিন্ন স্বার্থের বিভিন্ন ইসু্যতে সহমত পোষণ করে এবং জাতিসংঘ, ন্যাম, সার্ক এবং বিমসটেকসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সব দেশগুলোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। কেননা দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে প্রধান ও মহাবিশ্বে স্বীকৃত। বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর এমন কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, যেখান দিয়ে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের অন্তত ৫০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমে ভারত এবং পূর্বে ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও মিয়ানমারের উপকূলীয় দেশ। অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত গুরুত্বের কারণে এই অঞ্চল বরাবরই পূর্ব ও পশ্চিমের প্রধান শক্তিগুলোকে চীন, জাপান, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি রাশিয়াকে আকৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, সহযোগিতা ও কৌশলগত নানা চুক্তি স্বাক্ষর করার মাধ্যমে ভারত প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখতে ভারত তার ভৌগোলিক অবস্থানকে যথাযথভাবেই ব্যবহার করে থাকে। এদিকে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় শক্ত অবস্থান নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। চীন এবং ভারত উভয় দেশই এখন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের অবস্থান কঠোর করতে ব্যস্ত। আধিপত্য বিস্তারের কোনো সুযোগই এখন দু'টি দেশ একে অপরের সুযোগ দিতে রাজি নয়। উভয় দেশ যে কোনো উপায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে চায় এবং উভয় দেশই একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে কোয়াড। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত সমন্বিত কোয়াডের প্রধান উদ্দেশ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও কার্যকর করে তোলা ও এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, অবাধ বাণিজ্য ও নৌ-চলাচলসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নানামুখী সহযোগিতার ক্ষেত্র গড়ে তোলা। যা চীনের জন্য হুমকিস্বরূপ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই দক্ষিণ এশিয়া কোয়াডের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোয়াডের সাফল্য নির্ভর করবে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে তার ওপর। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময়ী হচ্ছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এখনো বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলো সঙ্গে নিরপেক্ষ ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে আসছে। এই নিরপেক্ষতার কারণে বাংলাদেশে কখনো কোনো রাষ্ট্রকে একক রাজনৈতিক সহযোগিতা করে না, বরং অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সমঝোতা ও বাণিজ্য করে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে উদীয়মান বিভিন্ন শিল্পকারখানা, খনিজ সম্পদ, বিদু্যৎ ও জ্বালানির প্রাচুর্য থাকার কারণে অনেক রাষ্ট্র বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান, জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আঞ্চলিক সংযোগ ও বাণিজ্যের একটি সম্ভাব্য কেন্দ্র করে তুলেছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব চীন, ভারত এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কাছে আরও বৃদ্ধি পাবে।
ওমর ফারুক রাদি : নবীন কলাম লেখক