রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১

বর্বরোচিত হামলা কেন?

দুষ্কৃতকারীরা এটা ভালোমতোই জানে যে, সঠিক তথ্য ও সংবাদ সময়মতো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যদি সাংবাদিকদের হয় তাহলে জনগণের জানমালের রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। নাশকতাকারীরা এটাও জানে যে, নাশকতা চালাতে গেলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হবে।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান
  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
বর্বরোচিত হামলা কেন?

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত কয়েকদিনে এক অস্থির ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো বাংলাদেশ। সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থাকে সংস্কার করার দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্রদের এই আন্দোলন দুষ্কৃতকারীদের বদৌলতে শেষ পর্যন্ত নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ এবং সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। এই সংঘাত এবং নারকীয়তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে সরকারকে বাধ্য হয়ে দেশজুড়ে কারফিউ জারি এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্তে আসতে হয়। বিগত কয়েকদিনের এই সংঘাতে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের যেমন প্রাণহানি ঘটেছে তেমনি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সাংবাদিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশজুড়ে চলা সহিংসতায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কমপক্ষে তিনজন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন এবং অর্ধশতাধিক গণমাধ্যমকর্মী গুরুতর আহত হয়েছে। কারফিউ চলাকালে পরিস্থিতি যখন অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সে সময়েও সোমবার নারায়ণগঞ্জে সংবাদ সংগ্রহকালে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের একজন নারী সাংবাদিককে নির্যাতন ও যৌন হয়রানির খবর এসেছে।

আক্রান্ত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী গত কয়েকদিনের নাশকতায় কমপক্ষে তিনজন পুলিশ সদস্য নিহত এবং ১২১ জনের গুরুতর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে দু'জন আইসিউতে জীবন-মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে একজন পিবিআইয়ে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক মাসুদ পারভেজকে সন্ত্রাসীরা রামপুরা এলাকায় সহিংসতা চলাকালীন সময়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে আহত করে এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃতু্য হয়।

পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, নাশকতাকারীদের টার্গেটে সাংবাদিক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকেই ছিল। গণমাধ্যমকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অতীতেও নৃশংসতার শিকার হয়েছে; তবে এবার যা ঘটছে সেটি সত্যিকার অর্থেই ভীতিকর। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর কেন এত আক্রোশ?

প্রথমত, আমাদের এটা বুঝতে হবে- যারা এই হামলা বা নাশকতাগুলো করছে তাদের বিক্ষোভকারী বলা বন্ধ করতে হবে। পরম আরাধ্য মেট্রোরেলের দু'টি স্টেশন ভেঙে দেওয়া, বিভিন্ন ফ্লাইওভারের টোল পস্নাজায় অগ্নিসংযোগ করা, সাংবাদিকদের দেখলেই তাদের মারতে আসা, হত্যা করা কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া এগুলো করে দুষ্ৃ্কতকারী, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এবং সন্ত্রাসীরা। এদের আর যাইহোক, বিক্ষোভকারী বলার কোনো সুযোগ নেই।

সাংবাদিকদের দেখলেই তাদের ওপর হামলেপড়া, সম্ভবত, এই পেশার প্রতি তাদের যে ক্ষোভ এবং আক্রোশ এই হামলা বা আক্রমণ সেটারই একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দুষ্কৃতকারীরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে একটা বার্তা দিতে চাইছে যে, দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে এবং সাংবাদিকরা এই পরিস্থিতিতে সংবাদ সংগ্রহ করতে যেন না যায়। তাতে সহিংসতা চালাতে তারা আরও অনুকূল পরিবেশ পাবে এবং সেই সংবাদ যাতে সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছায় সেই ব্যবস্থাও তারা নিশ্চিত করতে পারবে।

দ্বিতীয়ত, দুষ্কৃতকারীরা এটা ভালোমতোই জানে যে, সঠিক তথ্য ও সংবাদ সময়মতো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যদি সাংবাদিকদের হয় তাহলে জনগণের জানমালের রক্ষার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। নাশকতাকারীরা এটাও জানে যে, নাশকতা চালাতে গেলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে পড়তে হবে।

তাই স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ বা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রধান টার্গেট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করে তাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারলে নাশকতা করতে পারাটা তাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে।

পুলিশের ওপর হামলা করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাটাও নাশকতাকারীদের অন্যতম উদ্দেশ্য। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর, তাই এই জায়গাটিতে আঘাত করতে পারলে মানুষের আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরানো যাবে এটা নাশকতাকারীরা ভালোমতোই জানে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলে ফাটল ধারাতে পারলে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সফল হবে সেটাও তারা বোঝে। তাই এই হামলাগুলো যে পরিকল্পিত এবং টার্গেটেড সেটা বোঝার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হওয়ার আসলে প্রয়োজন নেই।

পরিশেষে এটা বলা যায় যে, গণমাধ্যম হচ্ছে সমাজের দর্পণ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার একটা আস্থার জায়গা। এই দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তাদের ওপর যখন হামলা এবং নৃশংসতা চালানো হয় সেটা সত্যিকার অর্থেই উদ্বেগজনক। তবে এত বাধা এবং চ্যালেঞ্জের মুখেও এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তারা যেভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তার জন্য সমগ্র জাতির কাছ থেকে তারা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান : সাবেক চেয়ারম্যান, মানবাধিকার কমিশন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে