শিশুশ্রম প্রতিরোধে করণীয়

শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করাসহ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশুশ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

আজহার মাহমুদ
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষৎ। আগামী দিনে দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে আজকের শিশুরাই। একটি শিশুকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই শিশুর পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯২৪ সালে জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে 'শিশু অধিকার' ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর করে। বর্তমান আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তুত্ম বাংলাদেশে দিন দিন বেড়েই চলছে শিশুশ্রম। হাজার হাজার শিশু শ্রম দিচ্ছে কলকারখানায়, গ্যারেজে, হোটেলে, রিকশা-টেম্পোর ওয়ার্কশপে। আবার অনেক শিশুকে দেখা যায়, বাস ও টেম্পোর হেল্পারের কাজ করতে। 'বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান' শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে যে কারণগুলো দেখানো হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চরম দারিদ্র্য, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীর মৃতু্য, পিতৃবিয়োগ, বাবা-মা পরিত্যাজ্য ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। অথচ যে বয়সে হাতে বই-কলম থাকার কথা, সেই বয়সেই তারা হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে কঠোর শ্রমের হাতিয়ার। নিজের কিংবা পরিবারের দুমুঠো অন্ন জোগাতে তারা এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। আমাদের দেশে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু পারিপার্শ্বিক কারণে স্কুলে যেতে পারে না। অনেকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে না। তাই মাঝপথে থেমে যায় তাদের পড়াশোনা। দেশের বিভিন্ন মাছের আড়তে, ওয়ার্কশপের হেল্পার বা কারিগর, মিস্ত্রি, মাটিকাটা, রিকশা চালানো, হোটেলবয়সহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ে এসব কোমলমতি শিশুরা। বাংলাদেশে ২০ লাখ গৃহশ্রমিকের মধ্যে ৯৩ শতাংশই অর্থাৎ ১৮ লাখ ৬০ হাজার শিশুই গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে। এসব গৃহশ্রমিক মানসিক, শারীরিক নির্যাতন ও আর্থিক শোষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ ধরনের কাজ করে থাকে শিশুরা। এসবের মধ্যে ৪৫টির বেশি কাজই হচ্ছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শ্রমিকের বৃহৎ একটা অংশ হচ্ছে পথশিশু। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দ্বিগুণ। শহরে কাজ করে থাকে ১৮ লাখ ও গ্রামে কাজ করে থাকে ৬৭ লাখ শিশুশ্রমিক। এসব শিশুশ্রমিকের মধ্যে ৪৭ লাখ শিশু নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো ও আইএলওর জরিপ মতে কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ রয়েছে ৪৫ ধরনের। তন্মধ্যে শিশুরা ৪১টি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। যারা গৃহপরিচালিকার কাজ করছে তাদের বয়স ১৬ বছরের নিচে। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে গৃহ-পরিচালিকার ৮৬ শতাংশ মেয়ে। ৩০ শতাংশের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর আর বাকিদের বয়স ১২ থেকে ১৬ পর্যন্ত। এরা প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে থাকে। শিশুশ্রমিকরা কাজে নির্ধারিত সময়ের চাইতে বেশি সময় দিলেও সে অনুযায়ী তারা তাদের শ্রমের দাম পায় না। কাজের চাপ ও নানা কারণে তারা ঠিকমতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে না। এসব শিশুদের সামান্যতম ভুল হলেই নিযার্তনের শিকার হতে হয়। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও হাত তোলে এসব অসহায় শিশু শ্রমজীবীর কোমল শরীরে। অনেক সময় গৃহকত্রীর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয় কোমলমতি শিশুরা- যা পত্রিকার খবরে প্রকাশিত হয় হরহামেশা। জাতীয় শিশুনীতি-২০১১ এর ৮ ধারার ৮.৯ এ বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানে শিশুরা নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশুরা যেন কোনোরূপ শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় এর ভিন্ন চিত্র। এ থেকে উত্তরণে সব শিশুশ্রম বন্ধের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজন সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ। সারাদেশে রেলওয়ে এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শিশুকুলিদের দল। এই পেশায় যুক্ত হওয়ার ফলে এদের মন মানসিকতার বিকাশ হয় না, বরং কুসঙ্গে থাকার ফলে এরা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বা অপরাধ চক্রে জড়িয়ে পড়ে। সিগারেট, ইয়াবা ও নানা ধরনের মাদকসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবনে এসব শিশুশ্রমিক অল্প বয়সেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক শিশু কাজ করতে গিয়ে চোখে আঘাত পেয়ে অন্ধ হয়ে পড়ে। অসুস্ত হয়ে পড়লে এদের কোনো খোঁজখবর নেয় না মালিকপক্ষ। আমরা জানি, সরকার শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীসহ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরেও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে- সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে বিনামূল্যে বই প্রদানসহ শিক্ষা বিষয়ক অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার্থে জাতীয় সব উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় শিশু নীতিমালা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যে শিশুদের আমরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ বলি তারা তাদের অধিকার কতটুকু ভোগ করতে পারছে? আগামীদিনের ভবিষ্যৎ শিশুদের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বা বাস্তবায়ন কৌশল কতটুকু স্পষ্ট? নানাবিধ আইন থাকার পরেও কেন শিশুরা শারীরিক নির্যাতন, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না? সর্বোপরি প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে করে, শিশুশ্রম প্রতিরোধের মিথ্যে গান আর কতকাল গাইব? সরকারের এসব বিষয় গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করাসহ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশুশ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। আজহার মাহমুদ : কলাম লেখক