দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি স্থিতিশীল- এ কথা বলা যাবে না। চারদিকে এক ধরনের গুমোটভাব বিরাজ করছে। স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এই স্থবিরতার প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। সেনা মোতায়েন ও কারফিউ জারি করার পরও পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি শান্ত হয়নি। সেনাবাহিনী প্রধান বলেছেন, শিগগিরই দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জনগণের অনেক ধনসম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। জানমাল রক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করেছে।
চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশনা রেখে রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করার নির্দেশও দিয়েছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য মতে, রোববার প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দীর্ঘ শুনানির পর এই রায় দেন। একইসঙ্গে হাইকোর্টের দেওয়া কোটা পুনর্বহালের রায়টি অকার্যকর ও বাতিল ঘোষণা করেন। পাশাপাশি ২০১৮ সালের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত কোটা বাতিলের পরিপত্রটিও রহিত করেন। ইতোমধ্যে আদালতের রায়ের আলোকে সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, কয়েকদিন ধরেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। প্রথমে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, সংঘর্ষ, হামলা এবং পুলিশের টিয়ার শেল, গুলি ও লাঠি চার্জের মধ্য সীমাবদ্ধ থাকলেও গত মঙ্গলবার থেকে তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। বিগত ছয় দিনে সারাদেশে অন্তত ১৮৭ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিক, পুলিশও রয়েছে। ৯০টির বেশি স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে আগুন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের্ যাব, পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও সেনাবহিনীর সশস্ত্র টহলের মধ্যেই বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সারাদেশে ১২০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে অপশক্তি ঢুকে পড়েছে। তারা বর্তমান সরকারের পতন ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই অপশক্তিকে দমন করার জন্য ধরপাকড় করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এর সঙ্গে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্র দল জড়িত। তারা সরকার উৎখাতের অপতৎপরতা চালিয়েছিল। এর আগেও বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল।
আমরা যদি দেশের জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকাই তা হলে কী দেখতে পাব। জাতীয় রাজনীতিতে চলছে পেশীশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার, লুটপাট আর দুর্নীতির মহোৎসব। অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন জনপ্রতিনিধিরাও। এর প্রভাব ছাত্ররাজনীতিতেও পড়েছে। তবে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক- যা পরবর্তীকালে সহিংসতায় রূপ নেয় তৃতীয় পক্ষ ঢুকে যাওয়ার কারণে। ফলে অনেক রক্ত ঝরলো। যা কেবল শোক বেদনা বাড়িয়ে তুলছে।
ভুলে গেলে চলবে না, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাই জাতীয় সব প্রত্যাশার পূর্ণতা দিতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা তো আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার কোনো বিষয় নয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার, দরকার ঔদার্য ও পরমত সহিষ্ণুতা। মুক্ত মতের প্রতিফলন ঘটানো যেখানে কঠিন, সেখানে নানা রকম অবস্থাই বিরাজ করতে পারে। আমাদের দেশে অবাধ মত প্রকাশের পথটা মোটেও মসৃণ নয়। এ নিয়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে। সচেতন মহল মাত্রই এ সম্পর্কে সবই জ্ঞাতও।
আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি একটানা দীর্ঘদিন ভালো থেকেছে- এমন নজির কম। একমাত্র গণতন্ত্রই সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। মানবিক মূল্যবোধ ও কল্যাণকে স্পর্শ করে। সবার জন্য রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ ও সুন্দর পথরেখা। একবার এই চমৎকার জিনিসটির মূল সমাজজীবনের গভীরে প্রবেশ করলে সব সময়ের জন্য এর চমৎকারিত্ব দ্রম্নতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং এর সুফল পেতে শুরু করে জনগণ। হিংসা-প্রতিহিংসা সহিংসতার মতো রূঢ়, অমানবিক-অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসাত্মক চেতনা মাটির সঙ্গে মিশে গেলে সমগ্র জাতির জন্য অনাবিল আনন্দের আবহ সৃষ্টি করবে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের রাষ্ট্র পরিচালক, রাজনীতিবিদ, রাজনীতির নীতিনির্ধারকরা কতটা নিষ্ঠ ছিলেন গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের ক্ষেত্রে? সমাজকে সুষ্ঠু ধারায় পরিচালনার ক্ষেত্রে। এই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতার কয়েক বছর পরই গণতন্ত্রের পথ অমসৃণ হয়ে গেল। নব্বই-পরবর্তী নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটেছিল। কিন্তু তাও হোঁচট খেল। গণতন্ত্রের পথ মসৃণ করার কথা সবাই বলেছেন, বলছেন; কিন্তু এরপর সমস্যা-সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্র কতটা ভয়ংকর হতে পারে, এই অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কমনীয়তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করলে এবং এর গভীরতা জাতীয় মননের সঙ্গে মিশে গেলে কোনো দিন তা আলগা হয়ে ভেদবুদ্ধি বা বিভাজনের করাল গ্রাসে অর্থহীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এ জন্য চাই জাতীয় নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং সুস্পষ্ট এক ভিশন।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি সমাজের সর্বস্তরে কার্যকর করতে হয়, তাহলে নতুন জীবনীশক্তির পরশমণির ছোঁয়ায় জাতির চিন্তাশক্তিকে নতুনভাবে জাগ্রত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন নির্বাচনব্যবস্থা স্বচ্ছ, অবাধ, গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের করা। রাজনীতি কল্যাণমুখী করা। পারস্পরিক সহযোগিতা ও শ্রদ্ধাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতীয় রাজনীতিকে সৃজনশীল ধারায় প্রবাহিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দলীয় আনুগত্য পরিহার করে জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠবেন- এমনটাই কাম্য। অবশ্যই প্রত্যাশা করি, হাজারও শর্তে বিভক্ত জাতি আবারও ঐক্যবদ্ধ হবে। নিজেদের অধিকার উপভোগ করে জনগণ সার্বিক নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার সুফল ভোগ করবে। কিন্তু এর জন্য তো করণীয় রয়েছে অনেক কিছু, যা সংশ্ল্নিষ্ট কারোরই অস্বীকারের পথ নেই। ভিন্নমতের দমন-পীড়ন গণতন্ত্রের সব মাধুর্য নষ্ট করে দেয়।
খুব দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এমন কিছু উপসর্গ রয়েছে, যেগুলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে খুব প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধকতার প্রেক্ষাপট সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। ভিন্নমতাবলম্বীদের মুক্ত বিচরণ, মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ করার মতো পরিস্থিতি যাতে বিদ্যমান থাকে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এসব বিষয় নিশ্চিত হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত হবে। আবারও বলতে হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই সব প্রত্যাশার পূর্ণতা দিতে পারে। আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এটিই মূল বিষয়।
একুশ শতকে এসে গণতন্ত্রের অবনমনের সূচনা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চালানো জরিপের জনমতে দেখা যাচ্ছে, আধা গণতান্ত্রিক অথবা একদলীয় শাসনের দেশের মানুষের চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি হতাশাগ্রস্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই হতাশার ব্যবধান অনেক বেশি। নিজেদের সরকার সম্পর্কে তাদের আস্থার মাত্রার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আস্থাশীলতার স্কোর অনেক নিচুতে।
জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসনই গণতন্ত্র। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা প্রদান করেন। আর যিনি এই সংজ্ঞা প্রদান করেন তিনি হলেন দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, সহযোগিতামূলক আচরণ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরমত সহিষ্ণুতাসম্পন্ন, মানবতাবাদী, গণতন্ত্র প্রেমী এবং বাগ্মিতায় অনন্য অসাধারণ আব্রাহাম লিংকন।
পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় কাজে অধিকসংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ট উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে, পরমতসহিষ্ণুতা ও বহুমতকে সহ্য করার প্রতি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নতি লাভে পুরোপুরি সফল না হলেও অর্জিত সাফল্য আশাব্যঞ্জক। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের তুলনায় তো বটেই, এমনকি নব্বইয়ের দশকের তুলনায় দারিদ্র্যের হার উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই।
স্মরণে রাখা উচিত, যেনতেনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা আর সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সুস্থ ধারায় সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার মধ্যে আকাশ-জমিন পার্থক্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সম্মিলিত উদ্যোগ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যাতে কোনো নাগরিক রাষ্ট্রীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় এবং অধিকার আদায় করতে গিয়ে রাজপথে কারো প্রাণ না যায়। কাজটি অনেক কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়।
সালাম সালেহ উদদীন : কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক