আশুরার দিনে যত ঘটনাবলি ও ফজিলত

মহরম হিজরি সনের ফজিলত ও শিক্ষার মাস। আত্মসচেতনতার মাস। মুসলমানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মাস। মহরম আসে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, সাহসিকতার পথ প্রদর্শক হিসেবে। মহরম আসে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্র্তা নিয়ে। মহরম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে মুছে নতুনরূপে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে। মহরম আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহণের অঙ্গীকার নিয়ে। মহরম যেন অফুরন্ত জয়ের উজ্জ্বল সূচনা।

প্রকাশ | ১৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

প্রফেসর মো. আবু নসর
হাদিস শরিফে চন্দ্রবর্ষের বারো মাসের মধ্যে মহরমকেই শাহরুলস্নাহ বা আলস্নাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবার ৩৬নং আয়াতে উলেস্নখ আছে- আরবায়াতুন হুরুম অর্থাৎ অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চারটি মাস হলো জিলকদ, জিলহজ, মহরম ও রজব। আরবি বর্ষপঞ্জি হিজরি সনের প্রথম মাস মহরম। মহরম শব্দের অর্থ সম্মানিত। মহরম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আশুরা শব্দটি আরবি শব্দ- যা আশারা থেকে এসেছে। আশারা মানে দশ এবং আশুরা অর্থ হলো দশম। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলে পাক (সা.) এরশাদ করেন- 'রমজানের রোজার পরে মহরমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।' মহররম ও আশুরার শিক্ষা হলো ত্যাগের মহিমায় নিজেকে উজ্জীবিত করা, সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ এবং অসত্যকে বর্জনসহ অন্যায়ের প্রতিবাদে দৃঢ়প্রত্যয়ী হওয়া, ষড়ঋপু নিয়ন্ত্রণে ব্রতী হওয়া (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য), নিষ্কাম কর্ম করা, আলস্নাহর ওপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল করা, তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা। হযরত হাফসা (রা.) বলেন, 'রাসূলে পাক (সা.) চারটি কাজ কখনো ত্যাগ করেননি। যথা- ১. আশুরার রোজা, ২. জিলহজের প্রথম ৯ দিনের রোজা, ৩. আইয়ামে বিজের রোজা তথা প্রতিমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের রোজা এবং ৪. ফজর ওয়াক্তে ফরজের পূর্বে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ।' মহরম মাসের আশুরার দিনটি সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি একটি ঐতিহাসিক দিন। এই দিনেই পৃথিবীর বহু উলেস্নখযোগ্য, স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস প্রসিদ্ধ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয় বলে প্রচলিত আছে। প্রচলিত সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলির মধ্যে এইদিনে- ১. পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ধ্বংস অর্থাৎ আলস্নাহ পাক লওহে মাহফুজ ও প্রাণিকুলের প্রাণ সৃষ্টি করেছেন, দুনিয়ার সমস্ত সমুদ্র-মহাসমুদ্র ও পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি তথা পৃথিবীর সৃষ্টি এবং একই সঙ্গে ধ্বংস, ২. হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করাও একই দিনে জান্নাতে প্রবেশ, ৩. একই দিনে হযরত আদম (আ.)কে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ, ৪. ৩৬০ বছর পর গুনাহ মার্জনার পর হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমতে পুনঃসাক্ষাৎ লাভ, ৫. ১৮ বছর রোগ ভোগের পর হযরত আইউব (আ.)কে রোগমুক্তি দান, ৬. হযরত ইদ্রিস (আ.)কে আকাশে উত্তোলন, ৭. হযরত নূহ (আ.)কে তুফান ও পস্নাবন থেকে পরিত্রাণ দান, ৮. হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে দুনিয়াতে আগমন ও পরবর্তী সময়ে একই তারিখে অগ্নিকন্ড থেকে নিষ্কৃৃতি প্রদান, ৯. হযরত দাউদ (আ.)কে বিশেষ ক্ষমা প্রদান, ১০. হযরত সোলায়মান (আ.)কে স্বীয় হারানো বাদশাহী প্রদান করা, ১১. হযরত ইউনূস (আ.)কে ৪০ দিন পর মাছের উদর বা পেট থেকে উদ্ধার, ১২. হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর স্বীয় হারানো পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ, ১৩. এদিনে হযরত মুসা (আ.)কে আক্রমণ করতে গিয়ে নীল নদে ডুবে ফিরাউনের মৃতু্য তথা ফিরাউনের কবল থেকে মুসা (আ.)-এর নিষ্কৃতি লাভ, ১৪. হযরত ঈসা (আ.) এর দুনিয়ায় আগমন ও পরবর্তী সময়ে এই দিনেই আকাশে উত্তোলন, ১৫. এই দিনেই আলস্নাহ তায়ালা পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন, ১৬. প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে মদীনা শরীফে গমন, ১৭. এই দিনে নবীকুল শিরোমনি মুহাম্মাদুর রাসূলুলস্নাহ (সা.) সর্বপ্রথম ওহি প্রাপ্ত হন, ১৮. জালিম এজিদের সৈন্য কর্তৃক কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার ৭৭ জন পরিবার-পরিজন, ঘনিষ্ঠজন নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ- যা ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা, ১৯. আলস্নাহ পাকের নির্দেশ অনুযায়ী কেয়ামত ঘটানোর লক্ষ্যে এই তারিখে হযরত ইসরাফিল (আ.) সিঙ্গায় ফুক দেবেন। এছাড়া, মহরম মাসে ফেরেশতাদের দ্বারা প্রথম মুসলমানদের পুণ্যভূমি কাবাগৃহ তৈরি করা হয়। এই মাসেই তুর পাহাড়ের পাদদেশে আলস্নাহ পাকের সঙ্গে হযরত মুসা (আ.)-এর কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন এবং তার নবুওয়াতি ও তাওরাত কিতাব লাভ হয়। প্রসঙ্গত উলেস্নখ যে, মহরম মাসের ১০ তারিখ দিনটিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায় সত্য আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদায়ক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ, ৬১ হিজরি সালে ১০ মহরম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরীর অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্র্র্র্র্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক এজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পরিবার পরিজন ও ৭৭ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদত বরণ করেন। মূলত কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মৃতু্য ঘটেনি, প্রকৃত মৃতু্য ঘটেছে পাপিষ্ঠ এজিদের। কারণ যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন ঘৃণা, নিন্দা, বিদ্বেষ, ধিক্কার ও অভিশাপ চলতে থাকবে এজিদ ও তার বাহিনীর ওপর। পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে দরুদের মাধ্যমে স্মরণ রাখবে সারা মুসলিম জাতি। এভাবে আজীবন সত্য, আদর্শ এবং ন্যায়, সততার বিজয় উদ্ভাসিত হবে। ১০ মহরম আশুরার দিনে বিষাদ সিন্ধু সংবলিত কারবালার নির্মম ঘটনা ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের দীক্ষা ও শিক্ষা। অন্যায়কে প্রতিহত করে সত্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষা আমরা কারবালার ঘটনা থেকে গ্রহণ করতে পারি। জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে তারা ন্যায়, সত্য ও আদর্শকে চিরভাস্বর করে রেখে গেছেন। সেই হৃদয়ভাঙ্গা বেদনাকে স্মরণ করে ১০ মহরম মুসলিম বিশ্ব কারবালার শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ইবাদত বন্দেগি করেন। উলেস্নখ্য যে, হযরত মুহম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেন, মহরম মাসের আশুরার দিনে রোজা রাখলে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ও গুনাহ আলস্নাহ মোচন করে দেন। আমাদের এ মাসে রসুলুলস্নাহ (সা.) এর প্রতি অধিক দরুদ ও সালাম পেশ, নফল নামাজ, কোরআন মজিদ তেলাওয়াত, আশুরার দিনে এবং অন্যদিনেও রোজা পালন হাদিস শরিফ অধ্যয়ন, দান-সাদকাহ ইত্যাদির মাধ্যমে আলস্নাহর নৈকট্যলাভের জন্য বিশেষভাবে ইসলামের কল্যাণে জীবনকে নিবেদিত করা উচিত। আশুরার রজনি এক মহিমান্বিত সম্মানিত, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, পুণ্যময়, বরকতময় ও মহাপবিত্র রজনি। এ রজনিতে উম্মতি মুহম্মদিদের সম্মান বৃদ্ধি করা হয়। এ রজনির শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য সর্বাধিক ও সুদূরপ্রসারী। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হলো ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা না থাকলে সমাজে কেউ নিরাপদ নয়। মহরম সব অন্যায়, পাপাচার, দুরাচার ও সহিংসতাকে বিসর্জন দিয়ে আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্মিকভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। মহরম হিজরি সনের ফজিলত ও শিক্ষার মাস। আত্মসচেতনতার মাস। মুসলমানদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার মাস। মহরম আসে অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, সাহসিকতার পথ প্রদর্শক হিসেবে। মহরম আসে নির্ভীক পথ চলার কল্যাণময় শুভ বার্র্তা নিয়ে। মহরম আসে আমাদের পুরাতন বছরের জরাজীর্ণতাকে ধুয়ে মুছে নতুনরূপে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে। মহরম আসে আমাদের নতুন শপথ ও প্রত্যয় গ্রহণের অঙ্গীকার নিয়ে। মহরম যেন অফুরন্ত জয়ের উজ্জ্বল সূচনা। প্রফেসর মো. আবু নসর : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ