প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নৈতিকতা
আমাদের সমাজে এহেন গর্হিত কাজের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়েছে এমন নজির খুব কমই আছে। অবৈধ আদান-প্রদান থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে নিষ্কৃতি প্রদান করা হয়েছে এমন নজিরের অভাব নেই
প্রকাশ | ১৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের যে কয়েকটি জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান আছে তাদের মধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশন অন্যতম। পাবলিক সার্ভিস কমিশন রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়োগের মতো অতিস্পর্শকাতর বিষয়সহ কর্মকর্তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা মূল্যায়নের মতো যাবতীয় কর্মকান্ড কমিশন সম্পন্ন করে থাকে। এছাড়া, পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিভিন্ন পরামর্শ যেমন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, বিভাগীয় মামলায় গুরুদন্ড বা অন্য কোনো শাস্তি, কোনো কর্মকর্তার পুরস্কার, বৈদেশিক নিয়োগ এবং বিভাগীয় মামলার ট্রাইবু্যনালে পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সর্বোপরি পিএসসি বিসিএস পরীক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাসমূহ বিভিন্ন স্তরে পরিচালনা করে থাকে। এই পরীক্ষাগুলোতে কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ নিয়ামক হচ্ছে সতর্কতা। অন্যান্য নিয়ামক হিসেবে স্বচ্ছতা, জাবাবদিহিতা এবং নৈতিকতার বিষয়গুলোকে উলেস্নখ করা যায়। এই পরীক্ষার কোনো নিয়োগ কর্মকান্ডে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কোনো প্রকার অনৈতিকতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে অথবা তাদের প্রশ্রয় দেয়া হয় তা হলে নিয়োগপ্রাপ্তির পর অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ওই সব কর্মকর্তা কোনোভাবেই রাষ্ট্রের কাজে দায়িত্বশীল হতে পারে না। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই সব কর্মকর্তারা সর্বদাই অনিয়মকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। অন্যায় ও বেআইনি কাজে তার সহকর্মী অধীনস্থদের উৎসাহ দিয়ে থাকেন। এভাবেই সব অবৈধ ও অনৈতিকতার জালের বিস্তার লাভ ঘটতে থাকে।
সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীর অনৈতিকতা ও অবৈধ কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ অর্থের আদান-প্রদান বিষয়ে পিএসসির কর্মকর্তা-কর্মচারী যোগসাজশ আছে বলে খবরে জানা যায়। এহেন অন্যায় ও গর্হিত কাজের সঙ্গে কিছু বহিরাগত মিলে একটি সিন্ডিকেট চক্র দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত আছে মর্মে জানা যায়। এ খবরটি প্রাথমিকভাবে দেশবাসীর গোচরীভূত হওয়ার ফলে তা একটি নিন্দনীয় আলোচনার ইসু্যতে পরিণত হয়েছে। খবরে প্রকাশ এই সিন্ডিকেটে জড়িত পিএসসির কর্মকর্তা, ড্রাইভার, অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক এবং বহিরাগত মিলে মোট ১৭ জনকে সিআইডি পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। বর্তমানে অনুসন্ধান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া পাবলিক সার্ভিস কমিশন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে বলে জানা যায়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনও বিষয়টি নিয়ে বসে নেই। তারাও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এ বিষয়ে প্রকৃত চিত্র অবহিত হতে চেষ্টা করবে মর্মে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন অনিয়ম বা অভিযোগের কথা যখন জনসমুখে চলে আসে, জনসাধারণকে বিভিন্ন স্টাইলে আশা ও আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে ঘটনার ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে এমনও বহু নজির আছে। তারপর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসময় গড়াতে গড়াতে জনগণের মন থেকে যখন তা মুছে যায় তখন দায়সাড়াভাবে একটা রিপোর্ট ফাইলবন্দি করা হয়। রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে হয়ত-বা প্রমাণিত অপ্রমাণিত সাপেক্ষে পরবর্তী কার্যক্রম গৃহীত হয়ে থাকে। তবে
আমাদের সমাজে এহেন গর্হিত কাজের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেয়েছে এমন নজির খুব কমই আছে। অবৈধ আদান-প্রদান থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে নিষ্কৃতি প্রদান করা হয়েছে এমন নজিরের অভাব নেই।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত অর্থাৎ চেয়ারম্যান সাহেব লটারি করে প্রশ্নপত্র বিতরণ করে একটি ডিফেন্সিভ পন্থার কথা উলেস্নখ করেছেন এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে এমনটাতে তিনি একমত নন। এ ক্ষেত্রে সব প্রশ্ন এবং সব পরীক্ষায় তিনি লটারি অনুষ্ঠিত করে থাকেন এটা কিন্তু চেয়ারম্যানের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট নয়। এছাড়া বিজি প্রেসে ছাপানোর কাজে যে মেকানিজম আছে সেই মেকানিজম থেকেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে পারে। অথবা বিজি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র সরবারহের পর পিএসসির ভল্টে রক্ষণাবেক্ষণ অবধি এই মাঝামাঝি সময়ে কোনো ঘটনার অবতারণা হতে পারে। এছাড়া প্রশ্নকারকদের নিরাপত্তা, প্রশ্নকারকদের প্রশ্নপত্র জমা প্রদান ইত্যাকার সামগ্রিক বিষয়ে স্তরে স্তরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন কি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা আছে তা কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট নয়। একজন চেয়ারম্যানের জনৈক ড্রাইভার আবিদ আলী কীভাবে এ চক্রের সঙ্গে জড়িত হলেন এ প্রশ্ন কিন্তু জনগণকে হতচকিত করে দিচ্ছে। একজন ড্রাইভারের চলাফেরা, আচার-আচরণ বা মতি-গতি পিএসসি'র চেয়ারম্যান মহোদয় অবগত হওয়ার বিষয়ে কখনো কি চেষ্টা করে থাকেন? তার গাড়ি চালনা দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তার পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের ইতিবৃত্তের খবরও চেয়ারম্যান সাহেব রাখতে পারেন। কিন্তু শুধু একজন ড্রাইভার কেন? পিএসসির মেম্বার থেকে একেবারে সর্ব নিম্নস্তরের সবার ব্যাপারেই একটি নজরদারি ব্যবস্থা থাকার কথা। একজন চেয়ারম্যান মনিটরিং মেকানিজমে তার অধীনস্থ প্রত্যেকেরই গতিবিধি, তার গাড়ি, বাড়ি, নারী, এমনকি হাঁড়ি এবং অন্যান্য সব শুভ-অশুভ এমনকি আর্থিক বিষয়াদি তার গোচরীভূত থাকা উচিত। নাজানাটা ব্যর্থতা বলেই আমার কাছে তা প্রতিয়মান হয়। না জানার দায় কোনো অবস্থাতেই পিএসসি প্রধান কেন অন্য কোন প্রতিষ্ঠান প্রধানও নিয়ে যেতে পারেন না। আর যদি নিয়ে যান তাহলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তিনি অযোগ্য বা অথর্ব বলে বিবেচিত হবেন। অন্যদিকে, এটা কোনো ভালো নেতার বৈশিষ্টের মধ্যে পরে না। কাজেই পিএসসির চেয়ারম্যান লটারি করে ২৫/৩০ মিনিট আগে প্রশ্নের সেট নির্ধারণ করে থাকেন। এ কথা বলে তিনি দুষ্টু গরুকে অন্যের গোয়ালে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বলেই মনে হয়। অথবা যত দোষ নন্দঘোষ- আমি সাধু। এ রকম সংস্কৃতির ধারক হয়েই আমাদের সামাজের সমাজপতিরা একটি প্রভাব বলয়ের ভেতরে চলে আসেন। যদিও পিএসসির চেয়ারম্যান সাহেব কোনো অনিয়ম বা অন্যায় হলে তিনিও স্পেয়ার্ড বা রক্ষা পাবেন না- এটাই জোড় দিয়ে বলেছেন। এটাতে তিনি তার নিজেকে সাফাই দিতে চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। এটার অবশ্য একটা ভালো দিক আছে। নিজের কনফিডেন্স লেভেলকে এ প্রক্রিয়ায় সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা নিম্নে প্রদত্ত প্রতিবেদন থেকে পিএসসির কর্মকান্ডকে বিতর্কিত করে তোলে বলে মনে হয়। পিএসসির কাজের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম ও কর্তৃত্ববাদের নমুনা আপনাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।
পিএসসিএর পরিচালনায় সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা, ফেব্রম্নয়ারি, ২০২৪-এর বিসিএস আনসার ক্যাডারের তৃতীয় পত্রের ফলাফল বিপর্যয় প্রসঙ্গে প্রতিবেদনটি নিম্নরূপ- সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতির জন্য একজন কর্মকর্তাকে তিনটি পত্রে কৃতকার্য হতে হয়। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে এ পরীক্ষা পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রতি বছর ফেব্রম্নয়ারি ও আগস্ট দুই ধাপে এই পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। চাকরিতে সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও পেশাদারিত্বের মান যাচাইয়ের লক্ষ্যে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে তিনটি পত্রের ওপরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পিএসসির চাহিদা মাফিক বিভিন্ন ক্যাডার থেকে কর্মকর্তারা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য কমন বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর তৃতীয় পত্রটি নিজ নিজ ক্যাডারের বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার এই ধারাবাহিকতায় আনসার ক্যাডার থেকেও কর্মকর্তারা প্রতি বছর অংশগ্রহণ করে থাকে। বিগত ফেব্রম্নয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত পরীক্ষায়ও আনসার ক্যাডার থেকে সহকারী পরিচালক পদবির ৩৬ জন কর্মকর্তা সি. স্কেল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে থাকে। তিনটি বিষয়ের মধ্যে বর্ণিত ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তাই প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রে কৃতকার্য হয়। কিন্তু অধিকাংশ কর্মকর্তা তাদের নিজেদের বিভাগীয় বিষয়ে তথা তৃতীয় পত্রে তারা অকৃতকার্য হয়- যা আনসার বাহিনীর ইতিহাসে এক দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের পত্রিকার সংশ্লিষ্ট ডেস্ক প্রতিনিধির সঙ্গে সহকারী পরিচালক মাফুজুর রহমান ও আজারুল ইসলামের সঙ্গে পরীক্ষার ফলাফল বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আমরা এই দুঃখজনক অভিব্যক্তির কথা অবগত হই। তারা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবেন- এ বিষয়ে নিজেদের ওপর খুবই আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছেন বলে আমাদের মনে হচ্ছে। তারা আমাদের প্রতিনিধিকে তথ্য প্রদান করেন যে, সাবেক ডিডিজি ড. ফোরকান উদ্দিন আহমেদ নিয়মিত পরীক্ষক, মডারেটর ও প্রশ্নকর্তা হিসেবে এযাবৎ এ দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। বর্ণিত পরীক্ষার তৃতীয় পত্রের খাতাগুলো পরীক্ষণের জন্য একজন অপেশাদার কর্মকর্তাকে নিয়োজিত করায় অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানায়। আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের প্রতিনিধিকে এক পর্যায়ে জানায় যে, বিগত দিনে বিভাগীয় পত্রের ফলাফল এমন নিচে নেমে আসেনি। সাবেক ডিডিজি ড. ফোরকান উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এ ফলাফলের বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাইলে তিনি আমাদের প্রতিনিধিকে জানান যে, আনসার ক্যাডারের প্রতি পিএসসির চেয়ারম্যান মহোদয়ের অবজ্ঞা ও উষ্মার কারণে এ ঘটনার অবতারণা ঘটেছে। তবে সার্বিকভাবে সঠিক পরীক্ষক কর্তৃক সঠিকভাবে খাতার পরীক্ষণ কাজটি সম্পন্ন হয়নি- এটাই প্রমাণিত হবে বলে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে এসেছে। তবে পরীক্ষক ড. ফোরকান উদ্দিন আহমেদ পি এস সি চেয়ারম্যানের দায়িত্বহীন কর্মের কারণে ফলাফল চিত্রের এ অবস্থা হয়েছে বলে তিনি জানান। তাই তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত এই ফলাফলের বিষয়ে এই দায়িত্বহীনতাকে নিন্দার চোখে দেখেন। অধিকন্তু তিনি পিএসসির মতো রাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বসম্পন্ন্ন জায়গায় কোন দায়িত্বহীন কর্মকর্তাকে সম্মানিত চেয়ারম্যান অথবা মেম্বার নিয়োগের ব্যাপারে সরকার বা রাষ্ট্রকে নির্মোহ ও বস্তনিষ্ঠতার পরিচয় রাখতে হবে মর্মে ড. ফোরকান ও আনসার বাহিনীর সাক্ষাতে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা আশা ব্যক্ত করেন।
প্রিয় পাঠক, উপরের বিশ্লেষণ ও বক্তব্যের আলোকে সংগত কারণেই দেশবাসীর মধ্যে পিএসসিকে নিয়ে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে তা স্পষ্ট করণের লক্ষ্যে সরকার ও রাষ্ট্রকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক