সময়ের গতিতে গতিশীল হয়ে প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে মানুষ এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারস্থ হচ্ছে। বিস্ময়কর বিষয় এই যে অকল্পনীয় এই বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী মানুষের জন্য সহজলভ্য। মানুষ এটি ব্যবহার করছে এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটির ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করবে। মানুষ শূন্যস্থান পূরণ করবে যন্ত্র কিংবা ভিন্নভাবে বললে বলা যায় মানুষের প্রয়োজনীয়তার জায়গা দখল করবে যন্ত্র। পরবর্তী যুদ্ধ হতেও পারে যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের টিকে থাকার যুদ্ধ তবু অধিক যন্ত্র সুবিধা (অসচেতনভাবে) লাভের আশায় আমরা অর্থনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সামর্থ্য লাভের প্রত্যাশায় পাগলপ্রায়- যা সময়সাপেক্ষে যৌক্তিক। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা শুধুই অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পেছনে ছুটছি কিনা এই প্রশ্নটি।
আরও এক ধাপ এগিয়ে ভাবলে বলা যায়, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পাশাপাশি বর্তমান সময়ের অস্থিরতায় আমরা সাইভার সিকিউরিটি সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছি। কারণ প্রযুক্তি এমন এক জাদুর স্পর্শ যার অধীনে আমরা ক্রমাগতভাবে নিজেদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সবকিছুকেই সমর্পণ করছি। খুব কম মানুষই সচেতনভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি- যা আমার অনিরাপদ করছে। তবে সাইভার সিকিউরিটি নিয়ে মানুষ যদি সচেতন হয় তবে হয়তো যন্ত্র থেকে আমরা নিরাপদে অবস্থান নিতে পারব অনেকটা যদিও তা সচেতনতার মাত্রার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে আমরা যেভাবে ভাবলেশহীনভাবে এগিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হচ্ছি সে জায়গায় আরেকটি সংকট মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে বলে বোধ হচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে প্রকৃত প্রিয়জনহীনতা- যা আমাদের সবকিছুর পরেও শূন্যতার দিকে নিয়ে যায়।
অর্থনৈতিক সক্ষমতা অসমভাবে হলেও হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে বলতে হবে যদিও সব ক্ষেত্রে নয়। যদিও টাকা একটি মুষ্টিমেয় শ্রেণির হাতে গচ্ছিত হচ্ছে এবং অবৈধভাবেই হচ্ছে বেশিরভাগ তবুও নিম্নবর্গ বা মধ্যবিত্তও জীবনযাপনে বিলাসবহুল জীবনযাপনকেই বেছে নিচ্ছে। এতে করে সম্পদের অসম বণ্টনের পাশাপাশি জন্ম হচ্ছে আরেকটি ধারণার- যার নাম হতে পারে সম্পদের অসম ব্যবহার। এর সঙ্গে সাংঘর্ষিকভাবে বেড়ে উঠছে নানান জটিলতা- যা মূলত ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের চাহিদা ও জোগান সংশ্লিষ্ট। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় যে, ব্যক্তির সীমিত সামর্থ্যের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদাটিই পূরণযোগ্য। কিন্তু এটি সবক্ষেত্রেই মানছেন না মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ। এর ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সহিষ্ণুতার স্থলে জায়গা করে নিচ্ছে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব- যা জাতির সংস্কৃতিগত সম্প্রীতিবোধকে দিনে দিনে হুমকির মুখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে বৃহত্তর বিচ্ছিন্নতা যা প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারকে উস্কে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্টোটিও ঘটছে। প্রযুক্তি সামাজিক করতে গিয়ে বর্তমান সময়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করছে অনেক ক্ষেত্রে।
পরস্পর বিচ্ছিন্ন এই মানুষের সামনের দিনে হয়ত এমন মানুষ খুঁজবে যার কাছে তার ইমোশন বা অনুভূতি এবং আত্মসম্মান নিরাপদ। অর্থাৎ আমরা উন্নয়ন আর প্রগতির পার্থক্য ভুলে যে পথে হাঁটছি অতি ত্বরায় সেপথ আমাদের ইমোশনাল সিকিউরিটির ভোক্তা বানিয়ে দিতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। এ দিকটা এখন ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বাহ্যিক চাকচিক্যের চোরাবালিতে আমরা অনেকে পা দিয়ে নিমজ্জিত প্রায়।
\হএকসময় আলাদা মোবাইল ছিল না সবার কাছে, এখন অনেকের কাছেই একাধিক মোবাইল। এক সময় বাসায় একটি কম্পিউটার ছিল। এখন একই বাড়িতে আলাদা আলাদা ল্যাপটপ। ব্যাংক একাউন্টও সবার আলাদা, কিন্তু কয় ব্যাংকে একাউন্ট এক একজনের সেটাই হিসেব করার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক মানুষের একাধিক ফেসবুক আইডি। কোনোটা প্রফেশনাল কোনোটা ব্যক্তিগত। যাদের একটি আইডি তাদের আবার ফেইক ইউজ। চাকরি কেউ করে একটা স্বপ্ন আরেকটা। টাকা এখন সবারই আছে। যার কম আছে তার একদিন বেশি হবে। বাইক বিক্রি করে দিয়ে গাড়ি কেনা হবে অনেকের। গরিব বড়লোকের জন্য রাস্তাও আছে পৃথক পৃথক মহাসড়কে। যানবাহন, খাবার আর জামা-কাপড় এখন মোবাইলের অ্যাপে। ঘরে বসেই পাওয়া যায়। শুধু নির্বাচন করতে হয় কোনটা কত দ্রম্নত পৌঁছায়। সব আছে। সব হবে। সব বিক্রি করছি আমরা। টাকা কিনছি। কারণ টাকায় কেনা যায় সব।
পরস্পর বিচ্ছিন্ন আমাদের কাছে একদিন হয়তো সব থাকবে চারপাশে অনুভূতি ছাড়া। আমরা টাকা দিয়ে না থাকা মায়া কিংবা ইমোশনাল সিকিউরিটি কিনব। প্রযুক্তির মতো একদল মানুষ হয়ত আবিষ্কার করে ফেলবে কীভাবে আমরা ইমোশনাললি সিকিউরিটি পেতে পারব। সবচেয়ে দামি জিনিসটা কিনতে হবে সামনে। এখন যেমন মৃত মানুষের জন্য দোয়া কিনি আমরা, সামনে জীবিত আমাদের জন্য মায়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। প্রকৃতিগতভাবে যদি আপনার ভাগ্যে দু'একজনের মায়া জুটে যায় তবে সাবধান! ওটা কেড়ে নেওয়ার জন্য দু'শত মানুষ থলি ভর্তি ঘৃণা নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। কেননা, হিসাব করে স্বার্থের সূত্রে ভালোবাসা ও কাছে থাকার দিন ফুরিয়ে আসবে। তাই মায়া পেতে করতে হবে দ্বিমুখী যুদ্ধ।
আসছে দিনে মায়াই হবে সেরা পণ্য আর আপনি আমি হব সেরা কৃত্রিম মায়া বিক্রেতা আর দামি মায়ার সস্তা খরিদদার।
শারমিন সুলতানা : শিক্ষক সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি