বছর তিনেক আগে আন্তর্জাতিক সাময়িকী 'সাসটেইনেবল সিটিজ অ্যান্ড সোসাইটি'তে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল। গবেষণার বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের ছয়টি বড় শহরের বাসযোগ্যতা পরিস্থিতি। গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরিতে যুক্ত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ক্যালগিরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষকসহ ছয়জন বাংলাদেশি গবেষক। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, প্রতি বছর বাংলাদেশের বড় বড় শহরগুলোর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে আশঙ্কাজনক মাত্রায়। এ ধারা রোধ করা না গেলে বাংলাদেশের রাজধানী মহানগরী ঢাকাসহ দেশের পাঁচটি জনবহুল মহানগরী (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট) আগামী এক দশকের মধ্যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। তিন বছর আগে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে যে, আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল তা ফলতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট 'দ্য গেস্নাবাল লিভেলিটি ইনডেক্স-২০২৪' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত ২৭ জুন। প্রতিবেদনটিতে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী বাসযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকাসহ বিশ্বের ১৭৩টি শহর স্থান পেয়েছে। শহর/নগরীর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, স্থিতিশীলতা, অবকাঠামো, পরিবেশসহ বাসযোগ্য নগরীর জন্য অতি আবশ্যকীয় দিকগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈয়ার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বাসযোগ্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে ১৬৮তম দেখানো হয়েছে।
সহজেই অনুমেয় যে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পুরোপুরি বাস অযোগ্য নগরীতে রূপ নেওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। ইআইইউ প্রতি বছর আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বিচার-বিশ্লেষণের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরীর বাসযোগ্যতার মান নিরূপণ করে অবস্থান প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরে। এবারের তালিকায় গত বছরের চেয়ে দুইধাপ নিচে দেখানো হয়েছে ঢাকা নগরীর অবস্থান। গতবারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান দেখানো হয়েছিল ১৬৬তম। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বাসযোগ্যতার দিক থেকে ঢাকা নগরী আরও খারাপ হয়েছে। ঢাকার নগরীর বাসযোগ্যতার মান ধারাবাহিক অবনতি 'দ্য গেস্নাবাল লিভেলিটি ইনডেক্স-২০২৪' চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ঢাকা নগরীর অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বাস অযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের ষষ্ঠতম স্থানের অধিকারী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আর মাত্র ৫ ধাপ নামলে বিশ্বে বাস অযোগ্য নগরীর শীর্ষে থাকবে ঢাকা নগরী।
ঢাকা এখনই কার্যত বাস অযোগ্য নগরী। বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় চাউর হয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী বাসবাসের জন্য বিপজ্জনক। গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, ঢাকায় নিঃশ্বাস নিলেও বিপদ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত (প্রায় ৮ বছর) ঢাকাবাসী নির্মল বায়ু পেয়েছে ৪৭ দিন। প্রায় ৮ বছরে মাত্র দেড় মাস ঢাকাবাসীর নির্মল বায়ু থেকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বর্তমানে অনিরাপদ বায়ুর মধ্যে বাস করার কথাই বলে থাকে নগরবাসী। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স' ২০২২ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বায়ুদূষণ ঢাকাবাসীর আয়ু কমাচ্ছে অন্ততপক্ষে ৭ বছর ৭ মাস।
ঢাকা নগরীকে বিষাক্ত বায়ুর নগরী সাব্যস্ত করাই যায়। ঢাকায় চলাচলকারী গাড়ির বড় অংশ থেকে অতিমাত্রায় ধোঁয়া নির্গত হয়। এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুয়ায়ী, গাড়ির ধোঁয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বিশ্বের তৃতীয় শহর ঢাকা। গাড়ির ধোঁয়া ছাড়াও ঢাকার অলিগলিতে, আবাসিক এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা নানা ধরনের কারখানা, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান, হোটেল-রেঁস্তোরার ধোঁয়া তো আছেই। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বু্যরো অব ইকোনমিক রিসার্চ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জরিপের মাধ্যমে ঢাকায় যানজটে জনপ্রতি কতঘণ্টা নষ্ট হয় তা বের করে জানিয়েছে; যানজটের কারণে ঢাকায় বছরে জনপ্রতি নষ্ট হয় ২৭৬ ঘণ্টা। ঢাকায় গাড়ি চলাচলের গড় গতি পায়ে হেঁটে চলার গতি থেকে খুব বেশি নয়। শব্দদূষণকে নীরব ঘাতক বলা হয়। ২০২২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শব্দদূষণে বিশ্বে শীর্ষ নগরী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ভূমিকম্প ঝুঁকিতে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্বের নিরাপদ শহরের তালিকায়ও ঢাকার অবস্থান তলানিতে। বিশ্বে অসহনীয় তাপমাত্রার শহরের মধ্যে ঢাকা নগরী অবস্থান ওপরের দিকে। চলতি বছর ঢাকায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। ঢাকা নগরীর তাপমাত্রা ফি বছর যেভাবে বাড়ছে তাতে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন ৫ বছর পর ঢাকায় গরমের মাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াবে। ঢাকা নগরীতে কয়েক বছরের মধ্যে মরুভূমির গরম অনুভত হবে- এমন বার্তা পাওয়া যাচ্ছে।
নগরী নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার জায়গা। রাজধানী শহর বা নগরীতে ডালাভরা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকে। ঢাকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধাকে 'তথাকথিত' বলা যায়। ঢাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই অলি-গলি, পাড়া-মহলস্নার লেন/বাইলেন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সামান্য বৃষ্টিতে ছোট-খাট খালে পরিণত হতে, কোনো কোনো সড়কে নৌকা চলাচল করতেও দেখা যায়। ঢাকার বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা যাচ্ছেতাই। ঢাকার জনাকীর্ণ, ব্যস্ততম এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রম্নব, ঢাকার অনেক এলাকায় প্রায়ই খাবার পানি/গ্যাস সংকট লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা নগরী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রাজধানী শহরের মানের বলার অবকাশ নেই। ঢাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রম্নব, অপহরণ সাধারণ ঘটনার মতোই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ঢাকা নগরীকে কংক্রিটের জঙ্গলে রূপ দিয়েছে। ঢাকা নগরীতে অগ্নিঝুঁকি উদ্বেগজনক পর্যায়ে। বিশ্বের নগরীগুলোতে সুশৃঙ্খল গণপরিবহণ ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা নগরীর গণপরিবহণ ব্যবস্থায় সীমাহীন নৈরাজ্য। বিনোদনের নানা ব্যবস্থা থাকে বিশ্বের নগরীগুলোতে। ঢাকা নগরীতে বিনোদনের ব্যবস্থা একেবারেই সীমিত। ঢাকায় শিশুরা বেড়ে ওঠে খাঁচায় বেড়ে ওঠা প্রাণীর মতো। কয়েক দশক আগেও বিভিন্ন এলাকায় কিছু খেলার মাঠ/খোলা জায়গা ছিল। এখন আর খেলার মাঠ/খোলা জায়গা গরু খোঁজার মতো খুঁজে বের করতে হয়। আদর্শ নগরীর ধারে কাছেও ঢাকা নগরী নেই।
ঢাকা নগরবাসী কার্যত নরকে আছে বলা হলে ভুল হবে না। অসহনীয় শব্দ ও বায়ুদূষণ, তাপমাত্রা ক্রমবৃদ্ধি, যানজট, ভূমিকম্প ঝুঁকি, জলাবদ্ধতা, বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনায় হ-য-র-ল অবস্থা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অনিরাপদ ভবন ঢাকা নগরীকে বাস অযোগ্য করে ফেলছে।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে জনগণের করের টাকায় পরিচালিত অনেক সংস্থা/প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান/সংস্থা 'ফর নাথিং' বলা যায়। বলা অন্যায্য হবে না যে, এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা, দুর্নীতি ঢাকা নগরীকে আজকের পর্যায়ে এনেছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী বাসযোগ্যতার মানের দিক থেকে বিশ্বের ১৭৩টি শহর/নগরীর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬৮তম- মানে এখনই বসবাসের জন্য চরম বিপজ্জনক শহর ঢাকা। দেশের রাজধানীর এ শহরকে বাসযোগ্য রাখার কার্যকর পদক্ষেপ কালবিলম্ব না করে নেওয়া জরুরি হলেও আন্তরিক গরজ পরিলক্ষিত হয় না। শুনতে খারাপ শোনালেও না বলে পারছি না যে, রাজধানী শহর/নগর বাসযোগ্য রাখার মুরোদ না থাকলেও, দেশ 'স্মার্ট' বানানোর খায়েশে কমতি নেই। দেশের রাজধানী শহর চোখের সামনে বাস অযোগ্য হয়ে পড়লেও টনক না নড়া বোধশক্তি হীনতার পরিচায়কই হচ্ছে।
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক