সত্যিই কি আমরা শিক্ষিত হচ্ছি!
প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
ইসমা খাতুন
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অর্জন করা। যে জ্ঞান মানুষের বিবেক বোধকে জাগ্রত ও বিকশিত করবে। কোনটা ভালো, খারাপ তা চিহ্নিত করে ভালো এবং খারাপের মধ্যে বাকবিচার করতে শেখাবে। সহজভাবে বললে আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন হলো শিক্ষা।
বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে কি সুশিক্ষিতদের সংখ্যাও বাড়ছে? সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য মানবীয় গুণাবলী, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান এইসব মানবীয় গুণাবলির অবক্ষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে দুঃখের বিষয় শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে দুর্নীতিবাজ বা বড় বড় অপরাধীদের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তাদের সংখ্যা মূর্খ বা অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিতরাই বেশি।
তারা বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জন করলেও কতজন বিবেক বিবেচিত শিক্ষা অর্জন করে? আমরা আমাদের শিক্ষাকে সার্টিফিকেট ও চাকরির মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। যার ফলে সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও সুশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। বর্তমান সমাজে যারা দুর্নীতি করে তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যাই বেশি পরিলক্ষিত হয়। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো অভাব নেই কিন্তু তাদের একটাই অভাব সুশিক্ষা। দুর্নীতি দেশ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তারা দুর্নীতি করে। ফলে সমাজে দুর্নীতি ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। শিক্ষা আমাদের সভ্য ও মার্জিত হতে শিখায়। আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি ঠিক কিন্তু সেই শিক্ষা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করি না। আর বাস্তবায়ন না করার ফলে আমরা মাঝেমধ্যে অসভ্য বর্বর হয়ে উঠি এবং এমন ঘৃণ্য অপরাধ করে বসি তখন আমাদের মানুষ ভাবতেও অবাক লাগে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন শিক্ষিত মানুষ অতি মাত্রায় আত্মকেন্দিক হয়ে পড়ে। নিজেদের অহংকার আর দাম্ভিকতায় অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কাজ করে না, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক এই চেতনা তারা হারিয়ে ফেলে। তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় যেকোনো কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না, মানুষ হতে শিক্ষিত বিবেক লাগে। আর শিক্ষিত বিবেক তৈরি হয় শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা অধিকাংশই শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা তো দূরের কথা চিন্তাই করি না। শিক্ষাকে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখি। এটাকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাস্তবায়নের প্রয়োজন বোধ করি না। প্রতিটি মানুষই বিবেকসম্পন্ন, কেউ তার বিবেককে পরিচর্যার মাধ্যমে জাগ্রত রাখে আবার কেউ তার বিবেককে অবহেলা, অবজ্ঞা এবং উদাসীনতার মাধ্যমে দাবিয়ে রাখে। বিবেককে ক্রমাগত অবহেলার মাধ্যমে বিবেকের অপমৃতু্য ঘটে এবং মানুষ-অমানুষে পরিণত হয়। একজন বিবেকসম্পন্ন মানুষ পারে তার শিক্ষাকে মূল্যায়নের মাধ্যমে সব প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ, জিঘাংসা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ-লালসা, অন্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে সমাজ, দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিতে। পক্ষান্তরে একজন বিবেকহীন মানুষ নিজ সহজাত প্রবৃত্তি ও অন্যায়ের কাছে শিক্ষা ও বিবেককে বিসর্জন দিয়ে সমাজ, দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের পথে ধাবিত করে। মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো মানুষের চিন্তাভাবনা করার শক্তি আছে আর প্রাণীর চিন্তাভাবনা করার শক্তি নেই। কিন্তু যখন আমাদের চিন্তাভাবনা করার শক্তি লোপ পায় তখন আমরা প্রাণীর মতো আচরণ করি। প্রাণীর যেমন তার কৃতকর্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা থাকে না তেমন আমাদেরও আমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা থাকে না। ফলে তখন শিক্ষা-দীক্ষা কোনো কাজে আসে না। একমাত্র বিবেক ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই পারে একটি সমাজকে সব প্রকার অন্যায়-অনাচারমুক্ত করে দেশ ও জাতিকে সুসভ্য করে গড়ে তুলতে। সমাজে আজ কোনো সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক বন্ধন নেই কিন্তু কেন? সমাজের সর্বস্তর থেকে ধৈর্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান, পরশ্রীমুখরতা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে মানছে না। ছোট বড়কে সম্মান করছে না, বড় ছোটকে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারছে না। জাতির মেরুদন্ড শিক্ষক লাঞ্ছিত হচ্ছেন স্বীয় গুণধর ছাত্রের দ্বারা। ছাত্র তার ছাত্রবন্ধু দ্বারা নিহত হচ্ছে। বর্তমান সমাজ সক্রেটিস'র সেই সমাজের যেন দৃষ্টান্ত- সক্রেটিস বলেছিলেন, 'এমন একটা সময় আসবে 'জ্ঞানীরা' জ্ঞানী হওয়ার জন্য অনুশোচনা করবে আর 'মূর্খরা' তাদের মূর্খতার জন্য গর্ব করে বেড়াবে আর 'দুর্নীতিবাজরা' তাদের দুর্নীতির জন্য উলস্নাস করে বেড়াবে।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা মানুষকে দক্ষ এবং জ্ঞানী করে তোলে। কিন্তু এর সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যেবোধের শিক্ষা না থাকলে সে কখনো ভালো মানুষ হতে পারবে না। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ না থাকলে বাস্তবিক এই শিক্ষা সমাজ বা মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বেশি করে। কেননা, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
আমাদের দেশে দিন দিন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। কারণ সুশিক্ষিত এবং সৃজনশীল তরুণ প্রজন্ম আগামী বাংলাদেশকে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে পারবে। দেশ থেকে যাবতীয় বৈষম্য বিলোপ এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে সৎ, নির্ভরযোগ্য এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন। সুশিক্ষার আলোর মাধ্যমেই দুর্নীতিমুক্ত এক উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। এজন্য শিক্ষা নয়, সুশিক্ষা জরুরি।
ইসমা খাতুন
শিক্ষার্থী
বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া