রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক উপাদানগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান। জনসংখ্যা ব্যতীত রাষ্ট্র গঠন কল্পনা করা যায় না। জনসংখ্যা একটি রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু অত্যাধিক জনসংখ্যা রাষ্ট্রের সম্পদ হওয়ার পরিবর্তে তখন রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বের জনসংখ্যা যখন ৫ বিলিয়নের ঘরে পৌঁছাল, তখন জাতিসংঘের উপলব্ধি হলো অত্যাধিক জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এ জন্য জনসাধারণের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা। আর এই জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসে একটি দিনকে 'বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। আর সে দিনটি হলো ১১ জুলাই।
১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদের তত্ত্বাবধানে এই দিবসটি সর্বপ্রথম পালিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশে ১৯৮৯ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালন করে আসছে।
জনগণের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই দিবসটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। অশিক্ষা, দারিদ্র্যের কারণে স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে পারেন না বহু মহিলা এবং তাদের পরিবার। সে ক্ষেত্রে সন্তান প্রসবের সময় বা পরে তাদের মৃতু্য পর্যন্ত হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ মহিলা গর্ভধারণ বা প্রসব নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃতু্যবরণ করেন। অতএব, এই দিনটির প্রধান লক্ষ্য হলো, পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান প্রদান করা এবং আরও বেশি সচেতনতা বাড়ানো।
জনসংখ্যাকে 'সম্পদ' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হলেও একবিংশ শতাব্দীতে প্রয়োজনের বেশি জনসংখ্যা বিশ্বের জন্য বোঝা। আর এই অত্যাধিক জনসংখ্যাই বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞের মতে অপুষ্টি, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়া ইত্যাদি মৌল মানবিক সমস্যার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা।
পৃথিবীর জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২৫০টি শিশু জন্মগ্রহণ করে। গবেষকদের মতে পৃথিবীর যা সম্পদ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ২০০-৩০০ কোটি লোককে সঠিকভাবে জায়গা দেওয়া সম্ভব! আর এ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশে নিত্যনতুন যুক্ত হচ্ছে অসংখ্যা সমস্যা। বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, সে হারে খাদ্যের জোগান নেই। অর্থাৎ, জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, আর খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে গাণিতিক হারে। এক গবেষণায় ওঠে এসেছে- প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ২৫,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিজনিত কারণে। পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এ ছাড়া সুপেয় পানির অপ্রতুলতা, বাতাসের বিষাক্ততা, সম্পদের বিলুপ্তি, বাসস্থানের সমস্যা, ওজোন স্তরের ক্ষয় ইত্যাদি বহু বিরুপ প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিশ্বকে। এর ওপর যুক্ত হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। আর এর মূলে রয়েছে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি। পৃথিবীর জনসংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে গেলে বা অত্যাধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে তখন প্রাকৃতিকভাবেই এর বিনাশ বা ধ্বংস হয় (ম্যালথাস তত্ত্ব মতে)।
বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন?বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে ২০৫০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২২ কোটিতে পৌঁছবে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচি বড় ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৫ সালে আট শতাংশ বিবাহিত নারী জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করতেন। এখন ৬৬ শতাংশ নারী ব্যবহার করেন। সত্তরের দশকে ভারতে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ছিল ১০ শতাংশের মতো, এখন তা ৬০ শতাংশ। পাকিস্তানে এই হার ৩০ শতাংশ। প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এখনো বাংলাদেশে দুর্গম অঞ্চল এবং চরাঞ্চলে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপ্রতুলতা রয়েছে।
বিশ্বের যেসব দেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, এর মধ্যে চীন অন্যতম। তারা কঠোরভাবে 'এক সন্তান নীতি' প্রয়োগ করেছে। কোনো নাগরিক তা না মানলে কঠোর শাস্তিরও বিধান রেখেছে। আবার অনেক দেশ বা অঞ্চল রয়েছে, যারা চীনের মতো কঠোর পদক্ষেপ না নিয়েও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য অর্জন করেছে। শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের কথা এ ক্ষেত্রে উলেস্নখ করা যায়। এ ক্ষেত্রে তারা যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, এর মধ্যে রয়েছে মানুষকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করা, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, শিশুমৃতু্য ও মাতৃমৃতু্যর হার উলেস্নখযোগ্যভাবে কমাতে পারা, বাল্যবিয়ে বন্ধ করা এবং জন্মনিরোধ পদ্ধতিগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। আশার কথা হলো, সম্প্রতি বাংলাদেশ জনসংখ্যার বৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখনো একটি বড় সমস্যা। কেননা, এখানে জনসংখ্যার ঘনত্বের হার সবচেয়ে বেশি। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঘাটতিসমূহ আমাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে বেকারত্ব; দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষার শিকার হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ।
একটি দেশে জনসংখ্যা তখনই সম্পদে পরিণত হয়, যখন প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা যায়। কিন্তু এই চাহিদাগুলো পূরণে এখনো বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিকল্পনার অভাবে পুরো জনসংখ্যাকে কার্যকর জনসম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই স্থবিরতা দেখা দিয়েছে, দেখা দিয়েছে বৈষম্য। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে এই ঘাটতিগুলো পূরণ করা অপরিহার্য।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির আরও একটি বড় সমস্যা হলো- মানুষের রাজধানীমুখিতা। বর্তমানে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বর্তমানে এক কোটি ৮০ লাখ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে দুই কোটি ৮০ লাখে।
সরকারি সব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিভাগের প্রধান কার্যালয়, এমনকি বেসরকারি বড় বড় কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান, প্রধান ও বিশেষায়িত সব হাসপাতাল, ব্যাংক, বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকায়। সঠিক পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবে বাংলাদেশের সব কিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে এবং দ্বিতীয় কোনো শহরে ঢাকার কাছাকাছি উন্নয়ন এখনো হয়নি। তাই জনসংখ্যা অনুপাতে কাজের সুষম বণ্টন ও সুষম উন্নয়নের স্বার্থে বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি হয়ে ওঠেছে।
জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন অত্যন্ত জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বর্তমানে প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গায় এক হাজার ১১৯ জনের বসবাসের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের সব ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং সমস্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব সমস্যা ভবিষ্যতে আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে দেশের মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষিত এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষায় জনগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ইমরান ইমন
ঢাকা