ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের শেষ কোথায়
প্রকাশ | ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সংগীত কুমার
'আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ' আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য। একটি শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, অথচ শিশুরা যে আজকেও আমাদের সমাজের কেউ একজন, তা আমরা ভুলেই যাই। 'শিশুরা হচ্ছে বাগানের কাদামাটির মতো। তাদের খুব সর্তক ও আদর-সোহাগ দিয়ে যত্ন করতে হবে'- জওহরলাল নেহেরু। মাদার তেরেসা বলেছেন 'প্রত্যেকটি শিশু একটি ফুলের মতো, তাদের প্রতিপালন করা আমাদের দায়িত্ব।' কিন্তু আমাদের দেশের শিশুরা কি আদৌ তাদের প্রাপ্য আদর-যত্ন দিয়ে প্রতিপালিত হচ্ছে? স্বাধীনভাবে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করতে পারছে? কিংবা আমরাই কি আমাদের সেই মহান দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছি? উত্তর হলো না। ফলে দেশে এতিম,পথশিশু ও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দেশের আর্থসামাজিক দূরবস্থার দরুন শিশুশ্রমের আধিক্য দেখা যায়। বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের আধিক্য আমাদের ভঙ্গুর আর্থসামাজিক দূরবস্থাকে নির্দেশ করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যুরো (বিবিএস) 'জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২' এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে। বিবিএস গত বছরের ৫ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত তিন মাসজুড়ে দেশের ৫-১৭ বছর বয়সি শিশুদের ওপর ওই জরিপ চালায়। জরিপে ৩০ হাজার ৮১৩টি পরিবার অংশ নেয়। জরিপের ফলাফল :
বর্তমানে দেশে মোট শিশুর সংখ্যা প্রায় চার কোটি।
১. দেশে বর্তমানে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক রয়েছে।
২. শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
৩. ২০ লাখ ৯০ হাজার শিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে।
৪. তাদের মধ্যে ২০ লাখ ১০ হাজার শিশু কোনো পারিশ্রমিক পায় না।
৫. যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ছয় হাজার ৬৭৫ টাকা।
২০১৩ সালে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ জন। অর্থাৎ গত ১০ বছরে সরকারের এত উন্নয়ন সত্ত্বেও শিশুশ্রমিকের সংখ্যা লক্ষাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গত কয়েক বছরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের মতো কমেছে। বিবিএসের জরিপ বলছে কৃষি, শিল্প ও সেবা - তিন খাতেই শিশুশ্রম আছে। এর মধ্যে কৃষিতে এক লাখ ৭০ হাজার, শিল্পে ১১ লাখ ৯০ হাজার এবং সেবায় ১২ লাখ ৭০ হাজার। তবুও সরকার নতুন অর্থবছরে শিশুশ্রম নিরসনে তেমন কোনো বরাদ্দ রাখেনি।
ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম কী?
শিশুশ্রমের সংজ্ঞা অঞ্চল, সংস্কৃতি, সংগঠন ও সরকারের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় শিশুশ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। জাতিসংঘ শিশু জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশুশ্রমকে এমন কোনো কার্যকলাপ হিসেবে সজ্ঞায়িত করে, যা শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। এর সংজ্ঞায় আরও বলা হয়েছে, শিশুশ্রম হলো- এমন একটি কাজ, যা শিশুদের শৈশব কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত করে শোষণ ও অপব্যবহার করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) মতে, ৫-১৪ বছর বয়সি শিশুদের যারা বেতন বা অবৈতনিক উভয় ক্ষেত্রে এক বা একাধিক ঘণ্টা (প্রতি সপ্তাহে) কাজ করে, তাদের শিশুশ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করে। ১০ বছরের বেশি বয়সি শিশুদের জন্য যেকোনো অর্থনৈতিক কার্যকলাপ শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে গৃহস্থালির ভেতরে এবং বাইরে উভয় কাজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অতএব, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হলো ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের শৈশব ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে- এমন কাজে ব্যবহার করা যেসব কাজে তাদের মৃতু্যঝুঁকি রয়েছে।
শিশুশ্রমের কারণ ও প্রভাব
১.দারিদ্র্য : দারিদ্র্য শিশুশ্রমের প্রাথমিক কারণ হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও স্বীকৃত। দারিদ্র্য নিরসনের নীতির মাধ্যমে শিশুশ্রম কমাতে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলও ও জাতিসংঘের প্রচেষ্টার দ্বারা দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের মধ্যে যোগসূত্রকে সমর্থন করা হয়। একটি দেশের আয়ের স্তর এবং শিশুশ্রমের হারের মধ্যে শক্তিশালী নেতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। মাথাপিছু আয় ০-৫০০ ডলার, ৫০০-১০০০ ডলার মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি শিশুশ্রমের হার ৩০-৬০% থেকে ১০-৩০% হ্রাস করতে পারে। যদিও বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবুও বাংলাদেশ মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৯-১৩% এখনো ৫-১৪ বছর বয়সি শিশুদের নিয়ে গঠিত। নগরায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি মতো বিষয়গুলো দারিদ্র্যকে স্থায়ী করে, যা শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ।
২. জনসংখ্যা তাত্ত্বিক : বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও জনসংখ্যা তাত্ত্বিকতা শিশুশ্রমের হারের পূর্বাভাস হতে পারে। শহরাঞ্চলের শিশুদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের শিশুদের কাজ করার সম্ভাবনা বেশি। কারণ হলো, বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাস ও ক্ষেত্রগুলোতে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের কাজ করার ঐতিহ্য।
৩. শিক্ষার অভাব : শিক্ষার অভাব শিশুশ্রমের অন্যতম প্রভাব। শিশুশ্রম শিশুদের স্কুলে পড়াশোনা ক্ষেত্রে বাধা। শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে অনেক নীতি শিক্ষার সহজলভ্য বৃদ্ধির ওপর দৃষ্টি নিবন্ধ করেছে। আইএলও ও ইউনিসেফের মতো সংস্থাগুলো দারিদ্র্য বিমোচন ও শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার রোধে শিক্ষার গুরুত্বকে স্বীকার করে। নিরক্ষরতার হার শিশুশ্রমের ব্যাপকতার পূর্বাভাস। সাক্ষরতায় পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে। বাংলাদেশে ৭৫% এর কম মেয়েরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে।
৪. সহজলভ্য : প্রাপ্তবয়স্ক একজন শ্রমিকের মজুরি কমপক্ষে ৫০০ টাকা, কিন্তু শিশুশ্রমিক দিয়ে তার অর্ধেক টাকায় কাজ করানো যায়। তাই অনেকে শিশুদের দিয়ে কাজ করাতে চান। এ ছাড়াও জোরপূর্বক শিশুশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৫টি পণ্য উৎপাদিত হয়।
শিশুশ্রম একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা যা সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি দেখা যায়। এটি শুধুমাত্র শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিশুশ্রমের প্রভাবগুলো হলো :
১. শিক্ষার অভাব : শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, ফলে তারা সঠিক শিক্ষার অভাবেই বড় হয়। এটি তাদের জীবনের সম্ভাবনাগুলোকে ছোট করে দেয় এবং ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়।
২. শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি : অল্প বয়সে কঠোর পরিশ্রমের কারণে শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার ফলে তারা ক্লান্তি, অপুষ্টি এবং বিভিন্ন মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিকভাবে তারা আতঙ্ক ও বিষণ্নতার শিকার হয়।
৩. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা : শিশুরা কাজের জন্য তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়। ফলশ্রম্নতিতে তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগে এবং তাদের সামাজিক দক্ষতা ও ক্ষমতা বিকশিত হয় না।
৪. অর্থনৈতিক অসাম্য : শিশুশ্রম অর্থনৈতিক অসাম্য বাড়ায়। কারণ, শিশুরা সাধারণত কম মজুরিতে দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য হয়, যা তাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে করতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম আইন
শিশুশ্রম আইন শিশুশ্রম অনুশীলনকে প্রভাবিত করে। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তানি শাসন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিশুশ্রম আইন প্রণীত হয়। যেমন 'শিশুদের কর্মসংস্থান আইন ১৯৩৮' এর দ্বারা ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুদের রেলওয়েতে কাজ করা এবং বন্দরের চাকরিতে পণ্য পরিবহণের অনুমতি দেয়। 'কারখানা আইন ১৯৬৫' দ্বারা ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের কারখানায় কাজ করতে নিষেধ করা হয়। 'দোকান প্রতিষ্ঠা আইন ১৯৬৫' দ্বারা ১২ বছরের কম বয়সি শিশুদের কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে নিষেধ করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
বাংলাদেশের সংবিধান মানুষের মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি দিলে অনুচ্ছেদ ৩৪-এর অধীনে সব ধরনের জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ করে। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ বলা হয়েছে যে, 'সকল প্রকার জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ এবং এই বিধানের যে কোনো লঙ্ঘন আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।'
শিশু আইন ২০১৩
শিশু আইন ২০১৩ পূর্ববর্তী আইন ১৯৭৪ বাতিল করেছে, যা আন্তর্জাতিক মান বিশেষ করে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯-এর সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। এই আইনের ধারা ৪ এ বলা আছে, প্রত্যেক ব্যক্তি ১৮ বছরের নিচে শিশু বলে গণ্য হবে। যদিও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার সুনির্দিষ্ট কোনো বিধান নেই। এটি শিশুদের শোষণসহ শিশুদের বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অপরাধ নিষিদ্ধ করে শাস্তি দেয় (ধারা ৮০)।
শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ
সরকার কোনোভাবেই শিশুশ্রম বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম বন্ধ করতে পারছে না। খোদ সরকারি জরিপ বলছে, নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত এক দশকে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এর জন্য সরকারের দায়সারা উদ্যোগ দায়ী নয় কী? সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে চায়। সে জন্য ২০২১ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু সরকার কি আদৌ ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে পারবে? এর আগে ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা প্রণয়নসহ নানা কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রণীত হয় 'জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি- ২০১০'। পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে 'ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম নিরসন' শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পও গৃহীত হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালে প্রণয়ন করা হয় 'গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি।' শিশুশ্রমিকদের একটি বড় অংশ নিয়োজিত আছে গৃহকর্মী হিসেবে এবং নির্যাতিত হয় সবচেয়ে বেশি। তবে এসব প্রকল্প ও নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় তেমন কোনো সুফল আসেনি।
সংগীত কুমার
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়