টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তিন দফায় বন্যায় আক্রান্ত হলো সিলেট। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে পানিবাহিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। দূষিত পানি পান ও বানের পানিতে চলাফেরা করায় ডায়রিয়া, চর্মরোগ, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন) ও চোখের রোগ দেখা দিয়েছে দুর্গতদের। সিলেট বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৮৬ জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি মৌলভীবাজারে পানিতে পড়ে একজনের মৃতু্য হয়েছে। আক্রান্তদের জন্য সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জসহ চার জেলায় ৬৭১ আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে ৪০৩ মেডিকেল টিম। বিভাগের চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বন্যাকবলিত হয়েছে সিলেটের ১৩ উপজেলার ১০১ ইউনিয়ন ও কয়েকটি পৌরসভা। একইসঙ্গে পস্নাবিত হয়েছে সিলেটের এক হাজার ১১৬ গ্রাম। বিভাগের ৪০ উপজেলার মধ্যে দুর্গত উপজেলা ২৬টি। ৩৩৪ ইউনিয়নের মধ্যে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫৩ ইউনিয়ন। বন্যাকবলিত এলাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ ও নগদ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এসবের কোনো সংকট নেই। ইতোমধ্যে বানভাসিদের মধ্যে চাল, শিশুখাদ্য, গোখাদ্য ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে বরাদ্দকৃত চাল ও নগদ টাকা যথাযথভাবে পাচ্ছে কিনা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
\হকেবল বাংলাদেশের অভু্যদয় থেকেই নয়; বন্যার সঙ্গে এ ব-দ্বীপের সম্পর্ক যেন সৃষ্টি থেকেই। তাই দেশের পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত, 'বন্যা না হলে তো বাংলাদেশ হতো না'। বাংলাদেশের অবস্থানটা এমন স্থানে যে, এতদ্ঞ্চলে বন্যার প্রবণতা রয়েছে। পাশাপাশি এ দেশের মধ্য দিয়ে প্রবহমান ছোট-বড় ২৩০টি নদী। বিভিন্ন কারণে এদের নাব্য হ্রাস, হিমালয়ের বরফগলা, উজানের দেশগুলো থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আর মানবসৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এ বন্যা বিপর্যয়।
এ ভূখন্ডে ব্রিটিশদের দখলের পর ১৭৬৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বন্যার তথ্য পাওয়া যায়। অত্র অঞ্চলে বন্যা নিয়ে মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে লেখা রয়েছে। ৩২১-২৯৬ খ্রিস্টপূর্বে চন্দ্রগুপ্তের আমলে এবং ৫০৭-৫৮৭ খ্রিস্টপূর্বে জ্যোতির্বিদ আর্যভট্রের লেখায় এ এলাকার বন্যার আভাস রয়েছে। এ বঙ্গে ১৮৭০-১৯২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অধ্যাপক পিসি মহলানবীশ প্রকাশ করেন যে, এখানে প্রতি দু'বছর পর পর মাঝারি এবং ৬-৭ বছর অন্তর বড় ধরনের বন্যার দেখা দিত। এমনকি এ সময় বন্যার কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের পুরোনো গতিপথের পরিবর্তন ঘটে। এ দেশে বন্যার দাপটের শুরু মূলত ১৯৫৪ সাল থেকে। ১৯৫৪-৯৮ সাল পর্যন্ত তিন যুগে প্রায় ৩২ বার বড় আকারের বন্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে ১৯৭০ সালে রয়েছে প্রলয়ংকরী বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। এ বছরের বন্যায় প্রাণহানি ঘটে ৫ লাখ মানুষের। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় প্রায় ১৩ লাখ টন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৮ ও ২০১৭ সালে পুরো দেশজুড়ে বন্যার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এসব বন্যায় দেশের ২০-৬০ শতাংশ এলাকা পস্নাবিত হতে দেখা যায়।
বন্যায় পানি ও খাদ্যবাহিত রোগ যথা- ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস ও পেটের পীড়া প্রভৃতি ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিবেশ দূষণের কারণে জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, নানা ধরনের চর্মরোগ, কঞ্জাংটিভাইটিসসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সুতরাং, এ বিষয়ে অধিক সচেতনতা জরুরি।