ছিনতাইমুক্ত সুন্দর শহর গড়ে তুলুন

ছিনতাইমুক্ত নগরী তৈরি করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সমাজ কুলষিত হলে আমাদের প্রজন্ম অন্যায়ের কাছে হেরে যাবে।

প্রকাশ | ১০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

রূপম চক্রবর্ত্তী
মনে করুন একজন বাইরের দেশের লোক বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে এসেছেন। হঠাৎ তিনি যদি কোনো ছিনতাইকারী দলের খপ্পরে পড়ে নিজের সবকিছু হারিয়ে ফেলেন তা হবে আমাদের জন্য লজ্জাকর। বেশ কয়েক মাস আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর রায়েরবাজার বধ্যভূমি এলাকায় ঘুরতে গিয়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন দুই জাপানি নাগরিক। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় পাসপোর্ট, ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ জাপানি ইয়েন, বাংলাদেশি ২৮ হাজার টাকা, দু'টি আইফোন, দু'টি ক্রেডিট কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, হেল্‌থ কার্ড, একটি পোর্টেবল হটস্পট ও একটি বস্নুটুথ ডিভাইস। তবে ঘটনার তিন দিনের মধ্যে তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় ডিএমপি মোহাম্মদপুর থানা। কোনো পর্যটক কক্সবাজার অথবা সিলেটে গিয়ে যদি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তাহলে বিষয়টা হবে খুবই বেদনাদায়ক। তখন এই পর্যটক বাইরে গিয়ে ছিনতাইয়ের কথা প্রচার করবে এবং অনেক পর্যটক বাংলাদেশে ভয়ে আসতে চাইবে না। দেশ যদি ছিনতাইমুক্ত হয় তাহলে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য আরও গতিশীল হবে। ছিনতাইকারী কবলে আমি নিজেও দুইবার পড়েছি। একবার সন্ধ্যাবেলা ইপিজেড থেকে বাসায় আসার সময় আমি সিএনজিতে একা ছিলাম। আমাকে বহনকারী গাড়িটি কাস্টম হাউসের পাশাপাশি নিমতলা ক্রস করার সময় দেখলাম তিন যুবক লাফ মেরে সিএনজিতে ওঠে পড়ে। একজন ছিনতাইকারী আমার কোলে বসে। বাকি দু'জন আমার দু'পাশে বসে। এরা আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ও টাকা নিয়ে যায়। তবে ছিনতাইকারীরা আমাকে মোবাইলের সিম ফেরত প্রদান করে এবং বাসায় আসার জন্য ২০ টাকা গাড়ি ভাড়া আমার পকেটে রেখে দেয়। তবে কষ্টের কথা এটাই আমার চোখে বেশ কিছু মরিচের গুঁড়ো লাগিয়ে গাড়ি থেকে আমাকে অন্ধকার একটা রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়। সেদিনের চোখের যন্ত্রণার কথা আজও মনে পড়ে। আরেকদিন সকালবেলা আমার স্ত্রীকে নিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। রিকশা নিয়ে পাথরঘাটা থেকে জিইসির মোড় যাচ্ছিলাম। চট্টগ্রাম কাজীর দেউরিতে পৌঁছামাত্র সিএনজি করে আসা ছিনতাইকারীর দল আমার স্ত্রীর হাত ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যায়। আমার মতো অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে নিজের প্রিয় ব্যাগ, টাকা, মোবাইল, গহনা এই ব্যক্তিদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সাধারণত ভোরে এবং সন্ধ্যার পর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ছিনতাইকারী বের হয়। অফিসগামী এবং অফিসফেরত রিকশাযাত্রী ও পথচারীরাই তাদের টার্গেটে থাকে। তারা চলন্ত অটোরিকশা থেকে ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে দ্রম্নত পালিয়ে যান। অথবা নির্জন স্থানে পথচারীদের আটকে টাকা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। টানা পার্টি ছাড়াও মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গামছা পার্টি নামে অনেক দল উপদল কাজ করছে। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ মোড়, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, ছোটপুল, বড়পুল, হালিশহর, কাস্টমস সেতু, বন্দর ফটক, ইপিজেড, অলংকার, টাইগারপাস, সিআরবি, পুরাতন রেলস্টেশন, নতুন রেলস্টেশনের মুখ, নিউমার্কেট, কোতোয়ালি, লালদীঘির পাড়, প্রবর্তক, কাতালগঞ্জ, শহীদ মিনারের সামনের সড়ক, বক্সিরহাট বিট, ষোলশহর, জিইসির মোড়সহ ৮১টি ছিনতাইপ্রবণ এলাকার তালিকা আগেই পুলিশের কাছে ছিল বলে সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, মাদকসেবী ও বিভিন্ন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের নামও এই তালিকায় আছে। তাছাড়াও বোস ব্রাদার্স, নন্দন কানন, জুবলি রোড, সিনেমা প্যালেসের আশপাশে ছিনতাই হয় বলে পথচারীদের অনেকে বলেছেন। প্রত্যেক জেলার মানুষ প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন কাজে প্রবেশ করছে। অনেক মানুষ ঢাকার অলিগলি সম্পর্কে জানেন না। এই সুযোগটা ছিনতাইকারীরা খুব ভালো করে কাজে লাগান। অনেক পথচারী ঢাকার রাস্তায় ছিনতাইকারী কবলে পড়েন। খালি পকেটে অথবা আহত অবস্থায় বাসায় ফিরে যান। পুলিশের অপরাধবিষয়ক মাসওয়ারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে গত দেড় বছরে ৪৮২টি ছিনতাই, ডাকাতি ও দসু্যতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত বছর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫৫টি। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে তেজগাঁও, উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডি, ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকায়। আরও আছে বাড্ডা, ভাটারা, মিরপুর ও পলস্নবী এলাকায়। শাহবাগ, মগবাজার, রমনা, মালিবাগ রেলগেট, চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা, গুলিস্তান, ধানমন্ডি, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, নিউমার্কেট, পান্থপথ মোড় ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায়ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজধানীতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূল কিশোর-তরুণ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাতে তারা প্রাথমিকভাবে জড়াচ্ছে ছিনতাইয়ে। দিনের বেলায় মোবাইল ফোনসেট, ব্যাগসহ জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ছে। রাতে তারা পথচারীদের ছুরি মেরে টাকা-মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিচ্ছে। এসব ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে অনেক মানুষ প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছেন। অনেক মানুষ পঙ্গু হয়ে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। অনেক ভালো পরিবারের ছেলেও নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য এসব ছিনতাইকারীর দলে নাম লিখাচ্ছেন। মা-বাবার ভার্সিটি পড়ুয়া একমাত্র ছেলে যদি ছিনতাইকারীর মামলায় জড়িয়ে জেল হাজতে রাত কাটান তাহলে মা-বাবার জন্য খুব কষ্টকর। ছিনতাইমুক্ত নগরী তৈরি করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি রাজনীতিবিদরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সমাজ কুলষিত হলে আমাদের প্রজন্ম অন্যায়ের কাছে হেরে যাবে। যেসব যুবক মাদকাসক্ত এবং ছিনতাই কাজে যুক্ত তাদের যদি রাজনীতির বাইরে রাখা যায় তাহলে খুব ভালো। তাই চলুন প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে ছিনতাইকে ঘৃণা করি। যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের দিয়ে উৎপাদনমুখী কিছু করা যায় কিনা সেটাও ভাবতে হবে। প্রত্যেক জেলা শহরের অলি গলিতে পুলিশ টহল বাড়ানোর পাশাপাশি যথেষ্ট পরিমাণ গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ছিনতাইকারীদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। ছিনতাইকারীদের হাতে আহত অথবা নিহত হওয়ার পর অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করতে অনেক সাহস করে না। যারা মামলা করবেন তারা যেন নিরাপত্তা বঞ্চিত না হোন তার দিকেও প্রশাসনের খেয়াল রাখতে হবে। জামিনে মুক্ত হয়ে একজন ছিনতাইকারী আবার যেন ছিনতাইয়ের কাজে লিপ্ত হতে না পারে সেদিকেও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। রূপম চক্রবর্ত্তী : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট