তিস্তার সংকটে মমতার মনোভাব

ভারতকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। পূর্বেও বাংলাদেশ-ভারত এর অমীমাংসিত সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে এখন অবধি ভারত বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিমতকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকাররের উচিত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিস্তার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাকে দূর করা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উচিত একগেয়েমি নীতি পরিহার করে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ বিবেচনা করা।

প্রকাশ | ০৯ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

মো. সাখাওয়াত হোসেন
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের কৃষি ও কৃষকের জীবনযাপন অনেকটাই নদীর পানির ওপর নির্ভর করে। বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি উপচে পড়ে এবং পানি চলে যাওয়ার পর যে পলি জমে সে জায়গায় ব্যাপক ফলন হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রকৃতি এমনভাবে সংযোজিত যেখানে ঋতু বৈচিত্র্যের সমাহার দেখা যায়। ঋতু বৈচিত্র্যের সমাহার কৃষি ও কৃষকের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যময়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে ঋতু বৈচিত্র্যে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঋতু বৈচিত্র্যে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কৃষকদের ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তথাপি কৃষকরা প্রতিকূল পরিবেশেও বাংলাদেশের কৃষিকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে এখনো পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। প্রতিকূলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি অমীমাংসিত সংকট। এই সংকটের কারণে একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে ব্যাপক পানির সমস্যায় পড়ে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। আবার বর্ষা মৌসুমে তিস্তার বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয় বাংলাদেশে। এর একটি সুষ্ঠু সুরাহা দরকার এবং এর নিমিত্তেই বাংলাদেশের অনেকেই ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পানি অর্থাৎ নদনদীর ওপর নির্ভরশীল। নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট-বড় অসংখ্য নদী রয়েছে। এর মধ্যে আন্তঃসীমান্তবর্তী নদী রয়েছে ৫৭টি। যার মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্তবর্তী নদীই ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আমাদের দেশের পানিসম্পদের রূঢ় বাস্তবতা হলো বর্ষা মৌসুমে পানির প্রাচুর্যতা ও শুকনো মৌসুমে পানির দুষ্প্রাপ্যতা। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ-ভারত ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যাও দেখা দেয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ যেভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পানির সমতা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটিও নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির অনুচ্ছেদ-৯ এর আলোকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনকে অগ্রধিকার প্রদান করে দুই দেশের মধ্যে বণ্টনের জন্য একটি স্থায়ী/দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক তিস্তা নদীটি ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়। পরে তা পদ্মা ও মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তিস্তার অববাহিকা আনুমানিক ১২ হাজার ১৫৯ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার পস্নাবনভূমি ২ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তীর্ণ। লাখো মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা এবং গৃহস্থালি দৈনন্দিন পানির চাহিদা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এটাও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। তিস্তার সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনুজীবিকা ও অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে বাংলাদেশ ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনার পর স্বাক্ষরের জন্য চুক্তির একটি খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ বাংলাদেশের এবং ৪২ দশমিক ৫ ভাগ ভারতের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২০ ভাগ থাকবে নদীর পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এরপর থেকে তিস্তা পানি চুক্তি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক কারণে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানি বণ্টনে বিরোধিতা করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে তার স্থানটি আরো পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। গত ২১-২২ জুন, ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরেও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তিস্তার পানি বণ্টনে তার তীব্র আপত্তি রয়েছে। তিনি এখনো এই চুক্তি স্বাক্ষরে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। মোদিকে লেখা চিঠিতে মমতা বলেছেন, 'বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ভারত সফরে এসেছিলেন সেই প্রসঙ্গে আপনাকে লিখছি। গঙ্গা ও তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে আপনাদের মধ্যে। কিন্তু রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে এই ধরনের আলোচনা প্রত্যাশিত নয়, সেটা গ্রহণযোগ্যও নয়।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ভৌগোলিকভাবে এই সম্পর্ক। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও আমাদের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। আমি বাংলাদেশের মানুষকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। কিন্তু পানি অত্যন্ত দামি সম্পদ। এটা মানুষের লাইফলাইন। এই সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আমরা আপস করতে পারি না। এই ধরনের চুক্তি হলে বাংলার মানুষ সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।' অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরীর মতে, 'পশ্চিমবঙ্গের আর ভারতের রাজনীতির যে পারস্পরিক টানাপড়েন বা বিরোধ, সেটাও তিস্তার জলবণ্টনের ওপরে বা সার্বিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা'। এদিকে মমতার বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে তিনি কোনোভাবেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে আগ্রহী নন। আবার বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তিস্তার চুক্তি সম্পাদন বারবার মমতার জন্যই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে কেবলমাত্র নিজের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর একসঙ্গে পথ চলা উচিত। সে কারণে প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধার দিকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তিস্তার বাংলাদেশের অংশে পানি সংকট দীর্ঘদিনের; এ অঞ্চলের মানুষের ব্যাপক নির্ভরতা তিস্তার পানির ওপর। এ দিকটিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেবল ভোটের স্বার্থ বিবেচনায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত আধুনিক পৃথিবীতে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভারতকে বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। পূর্বেও বাংলাদেশ-ভারত এর অমীমাংসিত সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে এখন অবধি ভারত বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিমতকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকাররের উচিত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিস্তার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাকে দূর করা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উচিত একগেয়েমি নীতি পরিহার করে প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ বিবেচনা করা। যেহেতু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে অবহিত তথা অনুমতি না নিয়ে চুক্তি করা নীতিবিরুদ্ধ- সেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আলাদা প্রণোদনা ব্যবস্থা করে হলেও তিস্তার সমস্যার সমাধান করা বাঞ্ছনীয়। মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়