সবুজে মোড়ানো দৃষ্টিনন্দন নীলকমল ও লালকমল লেক। বৃক্ষশোভিত জার্মপস্নাজম সেন্টার কিংবা এগ্রোনোমি ফিল্ড। প্রকৃতির মাঝে একাকার হয়ে আছে পাশের প্যারিস রোড। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাখিদের কিচিরমিচির আর মনোরম পরিবেশে ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে আরও দৃষ্টিনন্দন। বিশাল ক্যাম্পাসের মাঝে কৃষি খামার, সমৃদ্ধ শিক্ষার ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে সৃজনশীল প্রতিভায় যুক্ত করে নতুন এক উদ্দীপনা। এ যেন কৃষির এক অপূর্ব শোভিত মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। বলছিলাম পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) কথা। দক্ষিণবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ও গবেষণার আঁতুড়ঘর এ বিশ্ববিদ্যালয় দুই যুগ পেরিয়ে ২৫-এ পা দিচ্ছে। প্রতি বছর ৮ জুলাই পবিপ্রবিতে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু লগ্নে পটুয়াখালীর তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক মন্ত্রী মরহুম মোহাম্মদ কেরামত আলী (১৯৭৯-৮০) শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের অধিভুক্ত হয়ে বেসরকারি কৃষি কলেজ হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০০ সালের ৮ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এই কৃষি কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উদ্বোধন করেন এবং যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ অঞ্চলের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ বিলুপ্ত করে 'পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়' আইন পাস হয় এবং ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রম্নয়ারি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি বাস্তব রূপ লাভ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রসর অবদানের জন্য দেশ-বিদেশে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে।
ক্যাম্পাস পরিচিতি
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) ১০৯.৯৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পবিপ্রবির একটি বহিস্থ ক্যাম্পাস রয়েছে- যা বরিশাল জেলার খানপুরা, বাবুগঞ্জে ১২.৯৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বহিস্থ ক্যাম্পাসটি বরিশাল জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সর্বোমোট ৮টি আবাসিক হল ও ৯টি অনুষদের অধীন ৫৯টি বিভাগে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মেগা প্রকল্পসমূহ
তবে প্রতিষ্ঠার ২৪ বছর পার হলেও প্রায় প্রতিটি বিভাগে রয়েছে পর্যাপ্ত ক্লাস রুমের সংকট। কোনো কোনো অনুষদে প্রয়োজনের বিপরীতে নেই পর্যাপ্ত ল্যাব। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং মৌলিক ব্যবহারিক জ্ঞান। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ১০ তলা ও ৬ তলা বিশিষ্ট দু'টি একাডেমিক ভবন এবং শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থার উন্নতিকরণের লক্ষ্যে এবং গণরুম নিরসনে ১০তলা বিশিষ্ট শেখ হাসিনা হল এবং শেখ রাসেল হল নির্মিত হচ্ছে। মুক্তমঞ্চ, মিনি স্টেডিয়াম, আধুনিক ব্যায়ামাগার, সবুজ বেষ্টনীবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণসহ নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা রয়েছে সাগরসৈকত কুয়াকাটায় ফিশারিজ ফ্যাকাল্টি, সমুদ্র বিজ্ঞান ও ফরেস্ট্রি বিজ্ঞানসহ তিনটি পৃথক অনুষদের রিসার্চ সেন্টার তৈরি করার।
গবেষণায় পবিপ্রবি
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের আওতায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সাফল্যের সঙ্গে এ পর্যন্ত ৮০১টি গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। বর্তমানে নিজস্ব ও সরকারি অর্থায়নে ২০২২-২৩ সালে পরিচালিত গবেষণা প্রকল্প ১৫৩টি। পবিপ্রবিতে বেশ কয়েকটি উন্নত ও উচ্চফলনশীল ফলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে পিএসটিইউ বিলাতীগাব-১, পিএসটিইউ বিলাতীগাব-২, পিএসটিইউ ডেউয়া-১, পিএসটিইউ ডেউয়া-২, পিএসটিইউ বাতাবি লেবু-১, পিএসটিইউ কামরাঙ্গা-১, পিএসটিইউ কামরাঙ্গা-২, পিএসটিইউ তেঁতুল-১, পিএসটিইউ বৈচী-১ অন্যতম। উপকূলীয় এলাকার জন্য উন্নত ক্রপিং সিস্টেম ও বায়োচার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ১০০টি দেশীয় জাতের পাঁচ শতাধিক ধানের গবেষণা ও সংগ্রহশালা তৈরি, ভুট্টা ও সূর্যমুখী চাষে স্ট্রিপ পদ্ধতিতে ২২-২৫ শতাংশ বেশি উৎপাদনে সক্ষমতা আনয়ন এবং লবণাক্ততা ও জলামগ্নতাসহিষ্ণু ধান উৎপাদনের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে। মাছের দ্রম্নত বৃদ্ধিকরণ প্রযুক্তি, শুঁটকি তৈরি ও সংরক্ষণের নিরাপদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং দেশের প্রথম ও একমাত্র জলহস্তীর কঙ্কাল প্রস্তুতকরণ ছাড়াও উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক গবেষণা চলমান। কৃষিকে সমৃদ্ধ করতে প্রতিনিয়ত চলছে নানা ধরনের গবেষণা কার্যক্রম। এছাড়াও প্রোগাম বেইজড গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
শিক্ষার্থীদের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি ডিসিপিস্ননের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আমিন বলেন, 'দক্ষিণ অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ পেরিয়ে ২৫-এ পদার্পণ করল। হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন পূরণে প্রিয় ক্যাম্পাস সগৌরবে তার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমার ভাবনা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শতভাগ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হোক।'
তিনি আরও বলেন, 'সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে সুস্থ রাজনীতির চর্চা, খেলাধুলা, মুক্তচিন্তা, সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি গবেষণা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনের না হলেও, ১১০ একরের এই বিশালতার মাঝে আমিও একটি অংশ হতে পেরে অনেকাংশেই গর্ববোধ করি। শিক্ষা ও গবেষণায় পবিপ্রবি এগিয়ে যাবে বলে স্বপ্ন দেখি। পবিপ্রবির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। তবে এখন বেশি প্রত্যাশা থাকবে করোনায় দেড় বছরের সেশনজট দ্রম্নত কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় তার একটা মাস্টারপস্ন্যান কার্যকর করা।'
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক মাস্টারপস্নান এ পর্যন্ত তৈরি করা হয়নি। বর্তমান ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ডক্টর স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত একাডেমিক মাস্টারপস্নানসহ ফিজিক্যাল মাস্টারপস্নান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সমুদ্রসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও গবেষণার জন্য কুয়াকাটায় মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপনের নিমিত্তে ৬০০ কোটি টাকার ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব স্থাপনা দৃষ্টিনন্দন ও পরিকল্পনামাফিক করার লক্ষ্যে মূল ক্যাম্পাস, বাবুগঞ্জস্থ এএনএসভিএম অনুষদ এবং কুয়াকাটায় প্রস্তাবিত মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত করে ফিজিক্যাল মাস্টারপস্নান তৈরি করার জন্য একটি ডিপিপি তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। এএনএসভিএম অনুষদকে আধুনিকায়ন করার জন্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। এই প্রকল্পে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারসহ অ্যানিমেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মূল ক্যাম্পাসেও আধুনিক কেন্দ্রীয় গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গবেষণাগার দু'টিতে আধুনিক গবেষণাসহ পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানিকৃত সব কৃষি পণ্যের গুণাবলি পরীক্ষা করা হবে। বাবুগঞ্জে অ্যানিমেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপিত হলে দক্ষিণাঞ্চলে মহিষ ও হাঁস লালনপালনের ওপর নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। তাছাড়া ৪র্থ শিল্পবিপস্নবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিগ্রি প্রদানকারী ইইই বিভাগ, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ ও বায়োমেডিকেল বিভাগসহ অন্যান্য যুগোপযোগী বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
উপাচার্যের বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, 'বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পটুয়াখালীসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মননশীলতা, আধুনিকতায় দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। এ অঞ্চলের অতীত গৌরবকে এ বিশ্ববিদ্যালয় আরও দৃঢ় ও সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণাঞ্চলের সত্যিকারের বাতিঘর হয়ে উঠুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সাদাফ মেহেদী : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়