১। একটি পরাধীন জাতির স্বপ্ন বা মর্যাদা বলতে কিছু নেই। তাই কোনো জাতিই পরাধীন থাকতে চায় না। কোনো জাতির ওপর শোষণ নির্যাতন যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখনই তার মধ্যে জন্ম নেই সংগ্রামী চেতনার। আমাদের দেশও এক সময় পরাধীন ছিল। স্বাধীনতার মহান রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা একদিনে অর্জিত হয়নি। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার আর রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের পরে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতা।
২। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে এবং আগরতলা থেকে সহজেই কসবা কিংবা আখাউড়া দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ কিংবা কুমিলস্না হয়ে ঢাকার দিকে যাওয়া যায়। তাই অবস্থানগত ও কৌশলগত কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই জেলাতেই বহু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মাটিতেই দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণবিসর্জন দেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ। মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাটি ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনস্থ ছিল। ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং পরবর্তী সময়ে মেজর হায়দার এবং সদর দপ্তর ছিল মেলাগড়। এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে উত্তরে গঙ্গা সাগর এবং দক্ষিণে বিবির বাজার পর্যন্ত প্রায় ৩৫ মাইল বিস্তৃত এলাকা ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সক্রিয় নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবুও প্রায়ই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত কারণে তা হাতবদল হয়েছিল।
৩। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন কামালপুর, মন্দভাগ ও কুটি এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। অপর ব্যাটালিয়ন শালদা নদীর দক্ষিণে নয়নপুর এলাকায় অবস্থান করছিল। মেজর খালেদ মোশাররফ নিজে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে নয়নপুর সড়কের কাছে অবস্থান নেন। মেজর সালেক শালদা নদী অতিক্রম করে শালদা রেলস্টেশনের পশ্চিম গোডাউন এলাকায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা নবগঠিত মুজিব ব্যাটারির কামান নিয়ে মন্দভাগে অবস্থান গ্রহণ করেন। সুবেদার জব্বার মর্টার সেকশন নিয়ে বায়েকের পেছনে অবস্থান নেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে আক্রমণের সূচনা করা হয়। ক্যাপ্টেন পাশার আর্টিলারি গানগুলো দিয়ে শত্রম্নর ওপর প্রবল গোলাবর্ষণ শুরু হয়- যাতে পাকিস্তানি বাহিনী পাল্টা প্রতিরোধ করতে না পারে। কিন্তু এই যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল গোডাউন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা। গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় মেজর সালেক পেছনে সরে আসতে বাধ্য হন। ফলে শালদা স্টেশন দখল করতে মুক্তিবাহিনী ব্যর্থ হয়। এ যুদ্ধে বিপুল পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করে। শালদা নদীর প্রথম যুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ায় মেজর খালেদ মোশাররফ পুনরায় শালদা নদী রেলস্টেশন দখলের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন গাফফারের ওপর ন্যস্ত করেন।
৪। ক্যাপ্টেন গাফফার পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। চূড়ান্ত আক্রমণের দিন নির্ধারণ করেন ৮ অক্টোবর। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ৭ অক্টোবর ছোট একটি বাহিনী দ্বারা গোবিন্দপুর ও চান্ডালা এলাকায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। পাকসেনারা বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে ভারী মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে এবং সারারাত খন্ডযুদ্ধ চলতে থাকে। পাকসেনারা ধারণা করেছিল প্রতিপক্ষ পর্যুদস্ত হয়েছে। ক্যাম্প পাহারা দেওয়ার জন্য রাজাকারদের নিয়োজিত করে পাকসেনারা বিশ্রাম নেয়। এই চমৎকার সুযোগে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পুরো উদ্যমে ৮ অক্টোবর সকাল ৮টায় শালদা নদী রেলস্টেশন আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন গাফফার পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তার কোম্পানিকে চারটি পস্নাটুনে ভাগ করে তিন দিক থেকে আক্রমণ করেন। চতুর্থ পস্নাটুনটি ফলোআপ পস্নাটুন হিসেবে অবস্থান নেয়। এই পস্নাটুনটির ওপর দায়িত্ব ছিল শত্রম্নর আক্রমণ প্রতিরোধ করা। নায়েব সুবেদার সিরাজের পস্নাটুন রেলস্টেশনের পূর্বপ্রান্তে শত্রম্নর পরিখার ওপর আক্রমণ করেন। নায়েব সুবেদার মলৈ মিয়ার পস্নাটুন রেলস্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে শত্রম্নর যোগাযোগ বিছিন্ন করে দেয়। নায়েব সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে একটি পস্নাটুন উত্তর দিক থেকে হামলা চালায়। তিন দিক থেকে এই অতর্কিত হামলায় পাকসেনারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ছেড়ে নদীর দক্ষিণে চলে যায়। নায়েব সুবেদার বেলায়েত এবং তার পস্নাটুন নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং দক্ষিণ তীরে ওঠে শত্রম্নর বাংকার ধ্বংস করে। পাকিস্তানি সেনারা বাধ্য হয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে চলে যায়।
৫। প্রথম যুদ্ধে আংশিক সাফল্যের পর মেজর খালেদ মোশাররফ শালদা নদী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের জন্য মিত্রবাহিনীর সহায়তায় প্রায় দুই ব্রিগেড আকারের বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ যুদ্ধে ৪, ৯, ১০ ইস্ট বেঙ্গল ও ভারতীয় বাহিনীর দু'টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন সরাসরি অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও ভারতীয় একটি আর্টিলারি ইউনিট ও মুজিব বাহিনী ব্যাপক ফায়ার সহায়তা প্রদান করে। রিইনফোর্সড কনক্রিট বাংকার শত্রম্নদের পুরো যুদ্ধজুড়েই সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছিল। ব্যাপক গোলন্দাজ সহায়তা পাওয়া সত্ত্বেও তা শত্রম্নদের পর্যুদস্ত করতে ব্যর্থ হয়। এই আক্রমণেও উভয় বাহিনীর ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
৬। কসবা অপারেশনে গিয়ে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ শত্রম্নর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারির গোলার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। মেজর খালেদ মোশররফের স্থলে মেজর সালেক চৌধুরী সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ৪ ইস্ট বেলৈর পুনর্গঠনকালে সুবেদার ওহাবকে সি কোম্পানি অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ভারত থেকে কমিশন্ডপ্রাপ্ত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিলকে সি কোম্পানিতে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দেওয়া হয়। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জামিল সি কোম্পানিতে যোগ দিলেও কার্যত কোম্পানির সার্বিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব থেকে যায় সুবেদার ওহাবের ওপর। মন্দভাগ ও শালদা নদী এলাকায় শত্রম্নর অবস্থানসমূহ এবং গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার কোম্পানির একটি পস্নাটুন মন্দভাগ গ্রামকে সামনে রেখে চাউলা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেতে নির্দেশ দিলেন। অপর পস্নাটুনটিকে প্রথম পস্নাটুনের বাম দিকে শালদা নদীর উত্তর এবং শত্রম্নর শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানকে সামনে রেখে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। সর্বশেষ পস্নাটুনটিকে প্রথম পস্নাটুনের ডান দিকে কায়েমপুরকে সামনে রেখে চানখোলা গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। এ ব্যবস্থায় প্রতিটি অবস্থানের সামনেই শত্রম্নর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। প্রায় প্রতিদিনই এসব অবস্থান থেকে শত্রম্নর সঙ্গে খন্ড যুদ্ধ চলতে থাকে।
৭। ১২ নভেম্বর শত্রম্নর শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করা হয়। তিনি তার পরিকল্পিত অপারেশনের কথা মুজিব ব্যাটারির কমান্ডার মেজর আবদুল আজিজ পাশাকে জানালেন। মেজর আজিজ পাশা তার আর্টিলারি গানগুলো দিয়ে প্রয়োজনীয় ফায়ার সাপোর্ট দেওয়ার আশ্বাস দেন। মেজর আবদুল আজিজ পাশা ও সুবেদার ওহাব অপারেশনটির ব্যাপারে ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক মেজর গাফফারের সঙ্গে আলোচনার জন্য রওনা হলেন। কোনাবনে পৌঁছে ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের কাছে অপারেশনটি পরিচালনার ব্যাপারে অনুমতি চাওয়া হলে তিনি তাতে সম্মতি দিলেন। সম্মতি পেয়ে সুবেদার ওহাব সি কোম্পানি হেড কোয়ার্টার চাউরাতে ফিরে আসলেন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আক্রমণের তারিখ এবং সময় ১৩ নভেম্বর ভোর চার ঘটিকা স্থির হয়। আক্রমণের ধরন এবং পস্নাটুনগুলোর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যথাসময়ে সি কোম্পানি আক্রমণ শুরু করে কিন্তু শত্রম্ন তাদের শক্ত অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল।
বিশেষ করে দু'টি পস্নাটুন (মাঝের ও ডানের) বেশি বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। সর্ববামের পস্নাটুন কিছুটা অগ্রসর হতে পারে। এরই মধ্যে রকেট লাঞ্চারের গোলার আঘাতে শত্রম্নর ৩/৪টি বাংকার ধ্বংস করা হয়। ওদিকে ওয়ারলেস সেটে মুজিব ব্যাটারি থেকে ফায়ার সমর্থনে অনুরোধ জানানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা খুবই সর্তকতার সঙ্গে শত্রম্নর অবস্থানের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকে। সব দিক থেকেই সার্বিক অবস্থা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে আসতে থাকল। ১০৬ মি.মি. আর আর এবং রকেট লাঞ্চার, ৬০ মি.মি. এবং ২ ইঞ্চি মর্টারগুলো নিখুঁতভাবে শত্রম্নর বাংকারগুলোতে গোলা নিক্ষেপ করে চলছিল। ওদিকে মুজিব ব্যাটারিও নিখুঁতভাবে গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে দেখা যায় যে, শত্রম্ন অবস্থান ছেড়ে রেললাইন ধরে দক্ষিণে মনোয়ারা গ্রামের দিকে পশ্চাৎপসরণ করছে। শত্রম্নর অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙা হয়ে যায়। শত্রম্নর প্রতিটি প্রতিরক্ষা অবস্থান তখন মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০/৬০ গজের মধ্যে। শত্রম্নর পক্ষ থেকে তেমন গোলা আসছিল না দেখে মুজিব ব্যাটারিকে গোলা নিক্ষেপ বন্ধ করতে বলা হয়। ৪ ইস্ট বেলৈর প্রতিটি সৈনিকই তখন জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে শত্রম্নর শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে ওঠে পড়ে। সকাল ৭টার মধ্যেই শত্রম্নর শক্তিশালী শালদা নদীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের পতন ঘটে।
৮। প্রতি আক্রমণের আশঙ্কা করে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রম্নর পরিত্যক্ত বাংকারে অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। শালদা নদী মুক্ত হওয়ার সংবাদ বিদু্যৎ বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা এসে প্রতিরক্ষা এলাকায় অবস্থান নেয়। ফলে বিকালের মধ্যেই পুরো শালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। শত্রম্নর মজবুত বাংকারগুলোই মুক্তিবাহিনীর নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হয়। ১৪ নভেম্বর দুপুর ১টার দিকে পাকস্তানিদের একটি শক্তিশালী দলকে মনোয়ারা গ্রামের পশ্চিম দিকে শালদা নদী গোডাউন এলাকা হয়ে তাদের শালদা নদী প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্দখলের জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যায়। প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে অগ্রসরমান পাকিস্তানিদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। প্রতিরোধের মুখে শত্রম্নসেনারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এ সময় নায়েব সুবেদার বেলায়েত তার দল নিয়ে দক্ষিণ দিকে পলায়নরত শত্রম্নসেনাদের পিছু ধাওয়া করেন। পাকবাহিনীও পশ্চাদপসরণের সময় পেছনের দিকে গুলি নিক্ষেপ করতে করতে যাচ্ছিল। এক সময় শত্রম্নর একটি বুলেট এসে নায়েব সুবেদার বেলায়েতের বুকে বিঁধে। সঙ্গে সঙ্গে তার দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শত্রম্নসৈন্য এরপর শালদা নদী পুনর্দখলের আর কোনো প্রচেষ্টা নেয়নি। অভূতপূর্ব এক জয় ছিনিয়ে এনেছিল ৪ ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকরা। তার কিছুদিন আগেই এই একই অবস্থান দখল করতে গিয়ে ব্যাপক গোলন্দাজ সহায়তাসহ স্টুই ব্রিগেড আকারের যৌথবাহিনী ব্যর্থ হয়। সেই একই স্থান ৪ ইস্ট বেঙ্গলের একটি মাত্র কোম্পানি আকারের সৈন্য দখল করে নিয়েছিল। এই অপারেশনটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি অনন্য অপারেশন হিসেবেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৫ নভেম্বর সকাল থেকেই সর্বস্তরের হাজার হাজার জনতা মুক্ত শালদা নদী এলাকা পরিদর্শনে আসতে শুরু করে। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিসেনারা পাকিস্তানিদের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে। স্বাধীনতার প্রবল প্রত্যয় ও সঠিক যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মুক্তিযোদ্ধাদের এ যুদ্ধে জয় লাভের কারণ। অভষ্ভপস্নখ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দুর্বল ছিল। এছাড়াও মনোবলের অভাবও তাদের পরাজয়ের একটি কারণ।
৯। অত্যন্ত প্রাচীন জনপদ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ জেলা আমাদের দেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, বাষট্টি, চৌষট্টি ও ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভূমিকা স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে ছিল অদ্বিতীয়। ৭ মার্চের জনসভায়ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাসভর্তি করে অসংখ্য লোক ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে যোগ দেয়। মুক্তিযুদ্ধেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলায় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
শালদা নদীর যুদ্ধ কৌশলগত কারণেই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছিল এমন এক যুদ্ধ যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের ফলে পুরো জেলাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিপীড়িত জনগণ ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে এবং প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে স্বাধীনতার বেদিমূলে নিবেদন করেছেন সানন্দে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুষ্টিমেয় পাকিস্তানের দালাল ছাড়া সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সর্বস্তরের জনগণের ত্যাগ ও নিষ্ঠা ইতিহাসে স্মরণীয়।
তথ্যসূত্র :
ক। ২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স কমান্ডার খালেদের কথা, মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া।
খ। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউলস্নাহ, বীর-উত্তম।
গ।মুক্তিযুদ্ধে দু'শ রণাঙ্গন, মেজর রফিকুল ইসলাম, পিএসসি।
মেজর মো. শাহরিয়ার হাসান : পিএসসি, এএসসি : কলাম লেখক, সেনা সদরে কর্মরত