শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীন সরকারি পলিটেকনিকসমূহের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (১০ম গ্রেড) নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন ২০২১ইং সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে, যা মে ২০২৪ইং মাসে শেষ হয়। কারিগরি অধিদপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী এ নিয়োগ দ্রম্নত সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু পিএসসিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চলমান এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাঝেই পূর্বে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফ্ট ইনস্ট্রাক্টরদের (১৩তম গ্রেড) সরকারি গেজেট বহির্ভূত পদোন্নতি চেয়ে করা মামলার কারণে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগের ফল প্রকাশ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে আছে। যার ফলে ঝুলে আছে হাজার হাজার চাকরি প্রত্যাশীর ভবিষ্যৎ। ১৩ ও ১৫তম গ্রেডভুক্ত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর গং কর্তৃক রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট মামলায় রুল ইসু্য না করে বাদীগণের দায়েরকৃত আবেদন (এনেক্স-আই) ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আদেশ প্রদান করেন। তৎপ্রেক্ষিতে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্যাডার বহির্ভূত গেজেটেড ও নন গেজেটেড (কর্মকর্তা-কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ মোতাবেক ১৩ ও ১৫তম গ্রেডভুক্ত ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টর (সপ/টিআর) পদ হতে ১০ম গ্রেডভুক্ত জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (টেক/নন টেক) পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করে আবেদনটি নিষ্পত্তি করেন। তা সত্ত্বেও ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টররা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে আবার রিট পিটিশন দায়ের করলে মহামান্য হাইকোর্ট জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (টেক/নন টেক) পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ প্রদান করেন।
ফলে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের অধীন প্রার্থীরা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করে চূড়ান্ত ফলাফলের অপেক্ষায় থাকা সত্ত্বেও জটিলতা দেখা দিয়েছে। আবার ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ক্রাফ্ট ইনস্ট্রাক্টর মো. আশিক মিয়া'র রিট পিটিশন (পিটিশন নং- ৫৭২১/২০২৪) দায়েরের প্রেক্ষিতে মহামান্য আদালতের স্থগিতাদেশের ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। যা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজসমূহের শিক্ষক স্বল্পতা নিরসন প্রক্রিয়ায় সরকারের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
গত ২৫ জুন ২০২৪ইং ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স, বাংলাদেশে (আইডিইবি) দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবিতে এবং বর্তমান গেজেট অনুযায়ী জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর (টেক) পদে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস এবং শতভাগ নিয়োগের মাধ্যমে চাকরির বিধান রেখে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অধিকার সংরক্ষিত রাখার দাবিতে কাকরাইলস্থ আইডিইবি ভবনে আয়োজিত সমাবেশ ও মানববন্ধনে সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুর রহমান বলেন, 'কর্মমুখী বা কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির কার্যকরী কৌশল গ্রহণ না করে কোনো কোনো মহল প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প-২০৪১ যাতে বাস্তবায়িত না হয় সেই ষড়যন্ত্র করছে। দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়তে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে কারিগরি শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কারিগরি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ১০০টি উপজেলায় প্রতিটিতে ১টি করে মোট ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যার মধ্যে নবনির্মিত ৯১টি টিএসসিতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সিলেট, বরিশাল, রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৪টি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন কাজ চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগে ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। তাছাড়া ৩২৯টি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্থাপনের নিমিত্তে ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
ব্যানবেইস'র ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬ হাজার ৮৬৫টি, যার মধ্যে সরকারি ৮৬৬টি ও বেসরকারি ৫ হাজার ৯৯৯টি। শিক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮৪ জন। আর মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৫০ হাজার ৯৩১ জন। তথ্যমতে, দেশে তিনটি স্তরে কারিগরি শিক্ষার পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এগুলো হলো সার্টিফিকেট স্তর (এইচএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল ও বেসিক ট্রেড কোর্স); ডিপ্লোমা স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং ডিগ্রি স্তর (বিভিন্ন বিষয়ে বিএসসি ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপেস্নামা ইন টেকনিক্যাল এডুকেশন)। এর বাইরে আছে বিভিন্ন মেয়াদি শর্টকোর্স। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১০ হাজার ৬৮৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৩ হাজার ২৩০ জন।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৯১টি। সরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের পদ রয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৭টি। এর মধ্যে এখনো অর্ধেকের বেশি শিক্ষক পদ ফাঁকা রয়েছে।
দেশের প্রথমসারির কারিগরি প্রতিষ্ঠান ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে শিক্ষক বা কর্মকর্তার ১৩৪টি পদের মধ্যে ৮১টি পদই ফাঁকা রয়েছে। জানা গেছে, এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মোট পদ ৬৬৭টি। এর মধ্যে শিক্ষকের ৩৯৪টি পদের মধ্যে ২৭২টি ফাঁকা। দেশের প্রায় সব পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) নানা সংকটে জর্জরিত। এর মধ্যে প্রধান সংকট শিক্ষকের। যে কারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থী বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক এনে 'অতিথি শিক্ষক' হিসেবে তাদের দিয়ে ক্লাস করানো হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও কাঙ্ক্ষিত নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হওয়ার কথা ছিল ১:১২। সেখানে এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৫০। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে সেটি ১:১০০ ছাড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালে কারিগরির জন্য সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষকের পদ সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে পলিটেকনিকের পদ ৭ হাজার ৪৫১টি। যার মধ্যে নন-ক্যাডার থেকে ৩৮তম বিসিএসে ৩৯৫, ৪০তম বিসিএসে ২৭৮ এবং ৪১তম বিসিএসে ২২৩ জন শিক্ষক তথা জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। টিএসসিতে ১ হাজার ৪০০ পদে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। সরকারের অর্থবছর অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগও ভাগ করা আছে। এসব নিয়োগ হয়ে গেলে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে শিক্ষক সংকট অনেকটাই কমে আসবে।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষক পদ এখনো ফাঁকা রয়েছে। তবে, সব পদে শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন জীবনঘনিষ্ঠ কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া বিশাল জনগোষ্ঠী জাতির কোনো উপকারে আসবে না। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেই ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, 'শুধু বিএ এমএ পাস করে লাভ নাই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুল, যাতে সত্যিকার মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবা।' কিন্তু কিছু দিকভ্রষ্ট ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরের ষড়যন্ত্রমূলক মামলার জন্য বিঘ্নিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া রূপরেখার বাস্তবায়ন। আমরা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এই মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তি চাই।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ
সদস্য ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি)