আমরা কেন দক্ষ জনশক্তি হতে পারছি না?
প্রকাশ | ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আব্দুলস্নাহ আল মুনাইম
আমাদের দেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলছে। একই সঙ্গে বাড়ছে মানুষের চাহিদা। দেশে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান দরকার, এর অর্ধেকও জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দেশের মানুষ দক্ষ জনশক্তি হিসেবে রূপান্তরিত হতে পারছে না। দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। যা একটি দেশের জন্য অশনি সংকেত। কিন্তু আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি, কেন আমরা দক্ষ জনশক্তি হতে পারছি না? একটি দেশের অদক্ষ, বেকার এবং অচল জনশক্তিকে বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে দেশ ও দেশের বাইরে কাজ করার জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার মতো গড়ে তোলাই হল দক্ষ জনশক্তি। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত হলো দক্ষ জনশক্তি। আমাদের শ্রমশক্তির দক্ষতা বাড়াতে পারলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী জনসম্পদে রূপান্তরিত হবে। পৃথিবীর বহু দেশে মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও শ্রমশক্তির অভাব রয়েছে। সেসব দেশে আমাদের শ্রমশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে আমরা নানাভাবে উপকৃত হতে পারি। দক্ষ জনসম্পদ রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ আছে। তাদের এই উপার্জিত অর্থ পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করবে। বিদেশে কর্মরত শ্রমশক্তির উপার্জিত অর্থ দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। বিরাট একটা অংশ বিদেশে কর্মরত থাকার ফলে দেশে খাদ্যের ওপর চাপ কিছুটা লাঘব করতে পারে। কিন্তু আমরা বরাবরই বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে ব্যর্থ। পর্যাপ্ত দক্ষতার অভাবে আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ গত কয়েক বছর আগেও পযুক্তির দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। তবে এখন বহির্বিশ্বের প্রযুক্তির ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। একসময়ের স্বল্প উন্নত দেশ বাংলাদেশ, এখন সবক্ষেত্রেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। কিন্তু এখনো সেভাবে বাড়েনি কর্মসংস্থানের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) 'এশিয়া-প্যাসিফিক এমপস্নয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮' শীর্ষক প্রতিবেদনে (২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত) বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে, যা ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এই হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এই অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রতিবছর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষ চাকরি তো পাচ্ছে, কিন্তু যে বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছে, সেই বিষয়ের সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রের কোনো প্রকার সংযোগ থাকছে না। এর অন্যতম কারণ বিসিএস। যে বিষয়েই পড়াশোনা করুক না কেন, দিন শেষে সবার লক্ষ্য থেকে বিসিএস। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর সবার টার্গেট থাকে বিসিএস পরীক্ষা। যা আমাদের দক্ষ জনশক্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রাকিব বলেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দক্ষ হওয়ার যে তীব্র ইচ্ছা, তা খুবই কম। কারও নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশন করার আগেই বা ভর্তি হওয়ার আগেই এ লক্ষ্য ঠিক করা উচিত ছিল। এ কারণে গ্র্যাজুয়েশনের পর নানামুখী হতাশায় ভুগতে থাকে তারা। দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠতে পারে না। আমরা চাই, একজন ছাত্রছাত্রী যে বিষয়ে পারদর্শী, সে বিষয়েই যেন দক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে তা আর হয় না। দক্ষ জনশক্তি না হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো ভাষাগত অজ্ঞতা। অনেক দেশেই শিক্ষাগত কারণে যেতে হলে বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। ইংরেজি ভাষায় তো অবশ্যই পারদর্শী হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অনেক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা লাভ করতে পারে না। দেশের বাইরে লেখাপড়া বা কাজের জন্য যেতে চাইলেও দিতে হবে ভাষাগত বিভিন্ন পরীক্ষা। যা ভাষার দক্ষতা পরিমাপ করবে। কিন্তু আমরা সেখানে পরীক্ষায় বসতে ভয় পাই। আমাদের উচিত, গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা। যাতে পরে বেকার থাকতে না হয়। দক্ষ জনশক্তি হওয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বৃদ্ধি করা। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী একাডেমিক পড়াশোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ কারণে তাদের মধ্যে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষমতাটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের সামনে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, যারা বিভিন্ন সংগঠন ও এক্সট্রা কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসের সঙ্গে জড়িত, তারা অন্যদের চেয়ে চাকরির বাজারে তুলনামূলক এগিয়ে থাকে। তাই জনশক্তি হতে গেলে একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। লেখালেখি, বিতর্ক, ইংরেজি শেখা, সাংবাদিকতা, উপস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এ ছাড়াও বর্তমানে খুব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের পুঁথিগত শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেহেতু শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে না, সে কারণেই শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারছেন না এবং অদক্ষ কর্মী হয়ে উঠছে। ফলে তারা দেশের উন্নতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের জন্য দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে, যাতে কোটি কোটি অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে। অথচ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে দেশেই এ রকম বিশেষজ্ঞ তৈরি করা সম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত ল্যাব ও প্র্যাকটিক্যাল সুবিধা না থাকার কারণে ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। যা দক্ষ জনশক্তি তৈরির অন্যতম বাধা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারব। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে সময়ের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কার বা ঢেলে সাজানোর সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
আব্দুলস্নাহ আল মুনাইম
শিক্ষার্থী
টু্যরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া