শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১

সামাজিক অবক্ষয় আধুনিকতা ও প্রযুক্তিগত প্রভাব

প্রযুক্তিগত অপব্যবহারের ফলে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় এতটাই ঘটছে যে তা আর কোনো যন্ত্রে মাপা সম্ভব হচ্ছে না।
সিদরাতুল মুনতাহা
  ০৬ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সামাজিক অবক্ষয় আধুনিকতা ও প্রযুক্তিগত প্রভাব

মানুষ সামাজিক জীব। সঙ্ঘবদ্ধভাবে বসবাস করাই হলো মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। আর এই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করার পেছনে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সামাজিক মূল্যবোধ। সামাজিক মূল্যবোধ অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, উদারতা, সহযোগিতা ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে আমরা সামাজিক অবক্ষয় বলে থাকি। আমাদের বর্তমান সমাজের অবয়ব লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, কিশোর-কিশোরী, তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে প্রত্যেক বয়সের মানুষই এই অবক্ষয়ের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।

বর্তমান যুগ হলো আধুনিকায়নের যুগ। আমাদের আধুনিক জীবন প্রযুক্তির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা প্রাচীন পাথরের যুগ থেকে আধুনিকতার যুগে পদার্পণ করেছি, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ভূমিব্যবস্থার উন্নয়ন করেছি, এমনকি স্থলভাগ থেকে আকাশপথে প্রযুক্তিগত কল্যাণ সাধিত হয়েছে। সর্বস্তরে প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতা বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবীকে উন্নতির শেখরে পৌঁছে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর নেতিবাচক ব্যবহার সমাজকে টেনে নিয়ে গেছে চরম অবক্ষয়ের দিকে।

অবক্ষয় শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ক্ষয়প্রাপ্তি। বর্তমানে ক্ষয়সাধন হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধের। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সঙ্ঘবদ্ধভাবে বসবাস করার জায়গায় মানুষের মধ্যে বাড়ছে আত্মকেন্দ্রিকতা, প্রতিহিংসা, অমানবিকতা ইত্যাদি। সেই সঙ্গে তরুণদের মধ্যে মাদকাশক্তি, পর্নোগ্রাফি, উগ্রতা, অপরাধপ্রবণতা, লেজুড়বৃত্তি রাজনৈতিক নেশা ইত্যাদি লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে চলছে। এছাড়াও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিশোর অপরাধ। এই সামাজিক অবক্ষয়ের পেছনে অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির অপব্যবহার। আধুনিকতা ও প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে এর নেতিবাচক ব্যবহার, যা সব শ্রেণিপেশার মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ বা যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে। যার ফলস্বরূপ সামাজিক অবক্ষয় বেড়েই চলেছে।

একটা সময় ছিল, যখন তরুণরা পর্ন বা পর্র্নোগ্রাফি শব্দ শুনলেই আড়ষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এখন এই বিষয় নিয়ে নেই কোনো আড়ষ্টতা, নেই সহজাত লজ্জা। বরং ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদের মাঝে পর্নোগ্রাফিতে আসক্তির মাত্রা ভয়াবহ আকারে বেড়ে চলেছে। এর কারণ হলো ইন্টারনেটে এসব ভিডিও বা অডিওর সহজলভ্যতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন উসকানিমূলক প্রচারণা। আজকাল প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যমেই নিয়মিত পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতা তুলে ধরা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, এর থেকে কতটুকু পরিত্রাণ পাচ্ছি আমরা?

'সাইবার অপরাধ' শব্দটির সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটি অংশ আশঙ্কাজনকভাবে জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে। বর্তমানে সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে। সাইবার অপরাধীরা মানুষের একাউন্ট হ্যাক করে তাদের ছবি, ঠিকানা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন আইনবিরোধী কাজ করে চলেছে। বিশেষ করে নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় ৭০ শতাংশই নারী যারা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

আমাদের সমাজে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের ছড়াছড়ি। সমাজে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো প্রযুক্তির অপব্যবহার। ফেসবুক, টিকটক, লাইকি, মাইস্পেসসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিশোর-তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ২৩৭টি কিশোর গ্যাং রয়েছে- যার মধ্যে ১২৭টি রয়েছে ঢাকার মধ্যে। এসব কিশোর গ্যাংয়ের ইভটিজিং, ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা এমনকি খুনের মতো অপরাধেও সরাসরি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে- যা সামাজিক অবক্ষয়ের একটি অন্যতম উদাহরণ।

ইন্টারনেট হলো এক বিশাল তথ্যভান্ডার, যেখানে আমরা নিজস্ব জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করার সর্বোচ্চ সুযোগ পেয়ে থাকি। কিন্তু এই বিশাল তথ্যভান্ডারের ধারে কাছেও ভিড়ে না বেশিরভাগ ব্যবহারকারী। আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষিত তরুণরা ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিও বস্নগিং করে অর্থ উপার্জনের জন্য- যা আসলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সময় ও মেধার অপচয় ছাড়া কিছুই না। বিটিআরসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। এর অধিকাংশই প্রযুক্তির অপব্যবহারে নিয়োজিত- যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।

এছাড়াও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অন্যতম একটি বাধা হয়ে রয়েছে মাদকাশক্তি। গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদে দেখা যায়, ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ডিজিটাল পস্ন্যাটফর্মগুলোতে খোলামেলাভাবে বিক্রি করা হচ্ছে মাদকজাতদ্রব্য যেখানে বেশিরভাগ ক্রেতা হলো তরুণ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৭৫ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে- যা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ভয়াবহ চিত্র।

প্রযুক্তিগত অপব্যবহারের ফলে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় এতটাই ঘটছে যে তা আর কোনো যন্ত্রে মাপা সম্ভব হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, নতুনত্বের প্রতি তরুণ সমাজের আসক্তি, পরিবারের উদাসিনতা, অপর্যাপ্ত শাসন, সামাজিক অসচেতনতা, ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে জীবনযাপন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব ইত্যাদি কারণে সামজিক অবক্ষয়ের মাত্রা চরমে পৌঁছেছে- যা সমাজের অগ্রগতিতে হুমকিস্বরূপ। আজকের আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজ যদি প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার করতে অসক্ষমতার পরিচয় দেয়, তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল তথ্যভান্ডার থেকে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে না পারে তাহলে বিশ্বপরিমন্ডলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই, সমাজের এই অবক্ষয় রোধে আধুনিকায়ন প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখে দিয়ে তা সংস্কার করতে হবে। এতে সরকার কর্তৃক নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

সিদরাতুল মুনতাহা :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে