পানির ন্যায্য হিস্যা ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

সময় এসেছে আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে মমতার অবস্থান পরিবর্তন করে পারস্পরিক সম্মান ও আস্থার মাধ্যমে দুই বাংলার উন্নয়ন নিশ্চিত করা।

প্রকাশ | ০৫ জুলাই ২০২৪, ০০:০০

মেহরাব আল মামুন
পৃথিবীর বিবর্তন, বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধনে নদনদী, জল ও জল পথের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিন্ধু নদ কেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা, নীল নদ কেন্দ্রিক মিশরীয় সভ্যতা, টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী কেন্দ্রিক পারস্য সভ্যতার বিকাশ আমাদের সবার জানা। জল পথ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উন্মেষ ঘটে। ইউরোপীয়রা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সমগ্র দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এক সময়কার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি রূপ নেয় যান্ত্রিক অর্থনীতিতে- যা থেকে শিল্প বিপস্নবের মহাবিস্ফোরণ ঘটে। ইউরোপ থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে আধুনিক কলকারখানা আর প্রযুক্তির ব্যবহার তারপরও কিন্তু ফুরিয়ে যায়নি জল, জল পথ, নদনদী, আর কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্ব। নদী কেন্দ্রীক নগর সভ্যতা বিশ্বে এখন পর্যন্ত মানব সভ্যতার সূতিকাগার। নদী পথ বদলের কারণে কত নগর বন্দর তার জৌলুশ হারিয়ে অস্তিত্ব সংকটে আছে তা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই। তাই নদনদী আর জল নিয়ে বিশ্বে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা সমীকরণ জটিলতা ছিল আছে এবং সমানতালে থাকবে। আর এসব সমস্যা সমাধানেও আছে আন্তর্জাতিক নদী আইন, স্থায়ী সালিশ আদালত, আর কূটনৈতিক নানা তৎপরতা। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিচারালয় (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঞৎরনঁহধষ ভড়ৎ :যব খধি ড়ভ :যব ঝবধ)-এর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ উপকূলবর্তী এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত সমুদ্রসীমা অর্জন করে। কিন্তু বহু পুরোনো তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি ইসু্যতে এখনো আটকে আছে বাংলাদেশ। যা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে আবারো আলোচনায় আসে। ভারত বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও কেবল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোড়া রাজনীতির জন্য তা আলোর মুখ দেখছে না। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও। বাংলাদেশে-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস বহুপুরোনো- যার সুবাধে ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও, শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে হয়নি। ২০১৫ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার আশ্বাস দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তা ছিল কথার কথা। বাস্তবে স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশ যেটুকু পানি পেতে পারে বাংলাদেশ তাই চায়, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নিজস্ব রাজনীতির স্বার্থে গঙ্গা পানিচুক্তি এবং তিস্তার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন, আবার কখনো বাংলাদেশ প্রীতির কথা বলছেন কিন্তু বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না। ১৯৮৩ সালে ২৫তম যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সভায় এককালীন ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তিস্তার ৩৬ শতাংশ জল পাওয়ার কথা ছিল। আন্তর্জাতিক নদীর হিস্যার আইনে এটাই রীতিসিদ্ধ। ২০১১ সালে আরেকটি চুক্তির কথা হয়েছিল, যার অধীনে বাংলাদেশ তিস্তার ৩৭.৫ শতাংশ জল এবং ভারত ৪২.৫ শতাংশ জল পাবে স্থির করা হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নদীর প্রবাহ কমার কথায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে এই চুক্তি আর স্বাক্ষর করা হয়নি। সেই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্র-রাজ্যের রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিশাল চিঠি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে আগাম সতর্কবার্তাই পাঠাননি জোর আপত্তিও তুলেছেন। যা ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্বে বড় বিপত্তির কারণ হতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। উপরন্তু উত্তরাঞ্চলীয় ৮-১০টি জেলার প্রাণস্পন্দন। ভারতের পার্বত্য রাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা রংপুর বিভাগ জুড়ে নানা শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে। ফলে বলা যায়, তিস্তা বাংলাদেশের অর্ধেক ভূখন্ডের কৃষি খাতের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ। গজলডোবায় ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে, তা উজানের সময় জলের প্রবাহকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে এবং বাংলাদেশের জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে। এতে প্রতিবছর অন্তত ১৫ লাখ হেক্টর জমির সেচ ব্যাহত হয়। গণমাধ্যমে আসা খবরে যা জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকলে ভারত সরকার তিস্তা চুক্তি করতে পারবে না- এমনটি নয়। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তির সম্পূর্ণ এখতিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের। গঙ্গা ও তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়ায় ভারত সরকারের ভূমিকাকেই বাংলাদেশের জনগণ প্রাধান্য দিচ্ছে। তিস্তা নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ প্রজেক্ট বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এটাও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশের ডালিয়া সীমান্তে তিস্তার গড় বার্ষিক পানির প্রবাহ ছিল ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক (ঘনফুট প্রতি সেকেন্ড)। ১৯৯৫ সালে গজলডোবা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর তা কমে ২ হাজার কিউসেকে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে সর্বনিম্ন প্রবাহ ১ হাজার ৫০০ কিউসেক থেকে ২০০-৩০০ কিউসেকে নেমে আসে। এটা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ভূপৃষ্ঠের পানির প্রবাহ হ্রাস এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থা পানির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে তিস্তা অববাহিকায় ভূগর্ভস্থা পানির স্তর গত এক দশকে প্রায় ১০ মিটার নিচে নেমে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় তা সেচের ক্ষেত্রে এবং কৃষি ফলনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফসলগুলোর একটি বোরো ধান উৎপাদনে এর প্রভাব ব্যাপক। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তার পানির ঘাটতির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান- যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। গত একযুগে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ইতিহাসে বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক গুরুত্ব অর্জন করেছে- যা সবার মুখে মুখে কিন্তু মমতা ব্যানার্জি তিস্তার পানি নিয়ে যে রাজনীতি করছেন তার এ ধরনের মনোভাব দু'দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করছে। সময় এসেছে আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে মমতার অবস্থান পরিবর্তন করে পারস্পরিক সম্মান ও আস্থার মাধ্যমে দুই বাংলার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। মেহরাব আল মামুন : কলাম লেখক