সাধারণত অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনকে আমরা দুর্নীতি বলে থাকি। প্রকৃতপক্ষে, অনৈতিক যে কোনো চিন্তা ও কর্মের সংঘটনকে দুর্নীতি বলা যায়। এ অর্থে 'দুর্নীতি' গভীর সংজ্ঞায়িত একটি বিষয় এবং এর ব্যাখ্যাও বেশ বিস্তৃত। তবে 'সরকার ও রাজনীতি' সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমরা সাধারণত তিন ধরনের দুর্নীতি দেখতে পাই; যথা- ১. অর্থনৈতিক, ২. রাজনৈতিক ও ৩. বুদ্ধিবৃত্তিক।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অর্থনৈতিক দুর্নীতি প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিশাল দুর্নীতির বিশদ ফাঁকফোকর মিডিয়াতে ফাঁস হওয়ার পর সমগ্র দেশে হৈচই পড়ে যায়। বর্তমানে দুদক তার দুর্নীতির তদন্ত কাজ চালাচ্ছে। সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রদানের ইসু্যতেও আলোচনা চলছে। তবে বিতর্কিত মিডিয়া আল-জাজিরার তথ্যসূত্রের বরাতে আজিজের বিরুদ্ধে সেনা প্রভাব খাটিয়ে ঘুষ, অবৈধ ঠিকাদারি ও নিজের দন্ডিত ভাইদের বাঁচানোর যে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র এনেছে তা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ বা নির্ভরযোগ্য তা যথার্থ নিরীক্ষণের দাবি রাখে। কেননা, অভ্যন্তীরণ অনুশাসনিক বিষয়ে বহিঃরাষ্ট্রের এমন হস্তক্ষেপ কুরাজনৈতিক সন্দেহকে জাগিয়ে তোলে এবং বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থে আমেরিকার অপকৌশলগত ষড়যন্ত্র উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, আত্মস্বার্থ চরিতার্থে আমেরিকার পক্ষপাতদুষ্ট তথা একচোখা নীতি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রমাণিত ও ঘৃণিত বটে। যাই হোক, এই দু'য়ের রেশ কাটতে না কাটতেই এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছাগল কান্ড নিয়ে আমলাদের দুর্নীতি গণসমালোচনায় আসে যদিও আমলাদের দুর্নীতি এ দেশে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ বিদেশে যেসব বাংলাদেশিরা দুর্নীতির অঢেল অর্থে অতিবিলাসী নিবাস গড়ে তুলেছেন তাদের অধিকাংশই আমলা মর্মে গণমাধ্যমের তথ্যে উঠে এসেছে। ইতোপূর্বে আওয়ামী সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিশাল দুর্নীতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তার অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। এর আগে পি কে হালদার ও হল মার্কের ব্যাংক কেলেংকারি ও ব্যাপক অর্থ পাচারের ঘটনাবলি দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় তোলে। বর্তমানে এগুলো বিচারাধীন আছে। এছাড়াও ক্যাসিনোকান্ড ও অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ও দন্ডপ্রাপ্ত ঢাকা মহানগরের আওয়ামী নেতা সম্রাট, এনু, রুপন, জিকে সেলিম, শামিম প্রধানসহ অনেকেই আওয়ামী সরকার আমলের দুর্নীতিবাজ হিসেবে সাড়া ফেলেছিল। প্রতি বছর প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয় এবং এ থেকে ডলার সংকটের সৃষ্টি মর্মে আওয়ামী সরকারের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী শামসুল আলম সম্প্রতি এক সেমিনারে এ তথ্য জানিয়েছেন- যা গভীর উদ্বেগের বটে! তবে অর্থ পাচারের দুর্নীতি বিগত অন্য সরকারের আমল হতে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হয়ে আসছে এবং এ বিষয়ে কোনো একক সরকারকে দায়ী করা যায় না।
বলাবাহুল্য, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। রীতিমতো রাষ্ট্র্রের নিয়ন্ত্রকরাই সরাসরি দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন। এ দুই ধরনের দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক রূপ পরিগ্রহ করেছিল। খালেদা-তারেকের সৃষ্ট বহুল আলোচিত-সমালোচিত 'হাওয়া ভবন' এসব দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ সংস্থায় পরিণত হয়েছিল। ২০০১-২০০৬ সালে এই হাওয়া ভবন তারেক রহমানের নেতৃত্বে কার্যত ছায়া সংসদের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। অনেক ক্ষেত্রে হাওয়া ভবনের অনুশাসনেই সরকার পরিচালিত হতো। খালেদা রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর (প্রয়াত) বহুল আলোচিত 'সিমেন্স বাংলাদেশ লিঃ' ও 'চায়না হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং' কোম্পানি সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি বিশেষ উলেস্নখযোগ্য। কোকোর সিঙ্গাপুরে 'জাসজু' কোম্পানির অ্যাকাউন্টের অনুকূলে ওই দুর্নীতির তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। এর একটি অংশ যুক্তরাষ্ট্র হতে আসে বলে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি দায়েরকৃত মানি লন্ডারিং মামলায় [মামলা সূত্র-১:০৯-পা-০০২১ (ঔউই)] তার সেখানকার সব আ্যাকাউন্ট বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। একই ঘটনায় বাংলাদেশের আদালত ২০১১ সালে তার বিরুদ্ধে ৬ বছরের জেল ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় সিঙ্গাপুর সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন ডলার ফেরত দেয়। এছাড়াও সিঙ্গাপুরে 'ফেয়ার হিল কনসালটিং প্রাঃ লি.' নামে একটি কোম্পানির অনুকূলে অর্থ আত্মসাতের মামলায় কোকোকে দন্ড হিসেবে অতিরিক্ত ৫.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সমালোচিত এসব দুর্নীতি জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ প্রযোজনায় প্রকাশিত 'আ্যাসেট রিকভারি হ্যান্ডবুক-এ গাইড প্রাকটিশনার্স' বুকে স্থান পেয়েছিল- যা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে দারুণভাবে ক্ষুণ্ন্ন করেছিল। এ ক্ষেত্রে তারেক রহমানের দুর্নীতিও উলেস্নখযোগ্য। তখন নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লি.-এর পরিচালক ও চীনের হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশনের এ দেশীয় এজেন্ট খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে বিদু্যৎ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঘুষবাবদ গৃহীত ৭ লাখ মার্কিন ডলার সিঙ্গাপুরে তারেক পাচার করে। মার্কিন ফেডারেল বু্যরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং বাংলাদেশ সরকারের পৃথক তদন্তে মানি লন্ডারিংয়ের এই ভয়ার্ত তথ্য ওঠে আসে। এ মামলায় ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদন্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন। আওয়ামী সরকারের উদ্যোগে সিঙ্গাপুরের সিটিএনএ ব্যাংকে গচ্ছিত পাচারকৃত এই অর্থের আট কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়। ২০১৭ সালে সিঙ্গাপুরে ট্রেড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (এসটিডিবি) ও ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (ইডিবি) তাদের প্রতিবেদনে ১৮টি বিদেশি কোম্পানিতে অবৈধ সম্পদ আছে মর্মে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল- যার চারটিতেই জিয়া পরিবারের নাম ছিল। এছাড়াও ২০০৪ ও ২০০৫ সালে অর্থ পাচারের মাধ্যমে কেইম্যান আইল্যান্ড ও বারমুডায় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তারেক রহমান বিনিয়োগ করেন যা- 'প্যারাডাইস পেপারস' প্রতিবেদনে ওঠে আসে। বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদিআরবেও তার অবৈধ অর্থ বিনয়োগের তথ্য এতে ফুটে ওঠে। এতে জিয়া পরিবারের সংঘবদ্ধ দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। বিশেষ করে বিদু্যৎ সেক্টরে তারেকের সীমাহীন দুর্নীতি ভয়ানক আকার ধারণ করেছিল। ফলে দেশের কৃষি, শিল্প ও জনজীবনের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পরেছিল। বিদু্যতের দাবিতে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিক্ষোভরত সাধারণ মানুষের ওপর নির্দয়ভাবে গুলি চালিয়ে ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া অনেকেই আহত হয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৫ সালে কৃষি জ্বালানি ও সার সংকটের কারণে কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভরত সাধারণ কৃষকদের ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে ১৮ জন কৃষককে হত্যা করা হয়েছিল। বলাবাহুল্য, তৎকালীন সময়ে নেপথ্যে সরকার পরিচালনা করত তারেক রহমানই। তার প্রবল প্রভাবে মন্ত্রিপরিষদ এমনকি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত তটস্থ থাকত। বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এক গোপন তার বার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখেন, 'তারেক রহমান বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির জন্য দায়ী- যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে অত্যন্ত দুর্র্ধর্ষ ও ভয়ংকর এবং একটি দুর্নীতিপরায়ণ সরকার ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতীক। তারেক রহমানের প্রকাশ্য দুর্নীতি মার্কিন সরকারের তিনটি লক্ষ্যকে; যথা- গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উন্নয়ন ও জঙ্গিবাদ নির্মূল করার মিশনকে প্রচন্ডভাবে হুমকির সম্মুখীন করেছে।... আইনের প্রতি তার প্রকাশ্য অশ্রদ্ধা বাংলাদেশের জঙ্গিদের মূল শক্ত করতে সহায়তা করেছে।' এই প্রতিবেদনটি ইউক্লিকস ফাঁস করে এবং তা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনে তারেককে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়। ২০০৭ সালে তারেকসহ বিএনপির অন্তত এক ডজন নেতার ভিসা রিফিউজ করা হয়েছিল। অদ্যাবধি তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ ঘোষিত আছেন। ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত যুক্তরাজ্যের সানটান্ডার ব্যাংকে তারেক রহমান ও স্ত্রী জোবায়দার তিনটি হিসাব নাম্বারে পাচারকৃত ৫৯,৩৪১.৯৩ পাউন্ড জব্দের নির্দেশ দেন এবং ইউকে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে তা জব্দ বা ফ্রিজ করা হয়। সর্বশেষ, সুনির্দিষ্ট কোনো আয়ের উৎস ছাড়া লন্ডনে তারেকের দীর্ঘদিন ধরে যাপিত বিলাসবহুল জীবন ঘিরে আরও অনেক অজানা দুর্নীতির রহস্যের জট জড়িয়ে আছে বলে অনেকে মনে করেন। তারেক-কোকোর অর্থ পাচারের রোমহর্ষক দুর্নীতির বাইরে খালেদা জিয়ারও বহুমাত্রিক আর্থিক দুর্নীতির মামলা জাতীয় দুর্নীতির জ্বলন্ত অধ্যায় হয়ে আছে। এর মধ্যে নাইকো, গ্যাটকো, বড় পুকুরিয়া, জিয়া অরফ্যানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট সম্পর্কিত দুর্নীতির মামলা উলেস্নখযোগ্য। প্রসঙ্গত, এগুলো ১/১১ পরবর্তী ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তাতে বিএনপিরই চয়েস স্স্নিপে সুপারিশকৃত ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন-মইনুল-মতিন তত্ত্বাবধায়কদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকা মহানগরের বিশেষ আদালতের রায়ে 'জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট' দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদন্ড বাড়িয়ে ১০ বছর ধার্য করা হয়। আবার 'জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট' দুর্নীতির মামলায় সাত বছরের জেলদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা ধার্য হয়। নাইকো দুর্নীতি মালায় কানাডার আদালত ২০১১ সালের ২৩ জুন প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে খালেদা সরকারের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায় এবং বর্তমানে তা দেশের আদালতে বিচারাধীন আছে। এছাড়া গ্যাটকো, বড়পুকুরিয়া মামলাগুলোও বিচারাধীন আছে। দুর্নীতির এমন ভয়াবহ প্রকোপের ফলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই) ২০০১-০৬ সালে (খালেদার শাসনামল) বাংলাদেশ টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের তিরস্কার অর্জন করে, যা দুর্নীতির ইতিহাসে অদ্যাবধি সবচেয়ে কালো অধ্যায় হয়ে আছে।
পাশাপাশি এ সময়ে সংঘটিত রাজনৈতিক দুর্নীতি তো বলাই বাহুল্য! সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মদতে ২১ আগস্টের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। এতে ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হয় এবং আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে। '৭৫ পরবর্তী সবচেয়ে ঘৃণ্য রাজনৈতিক দুর্নীতি হিসেবে ইতিহাসে এটা কলংকিত হয়ে আছে। এছাড়াও শাহ এম এস কিবরিয়া, আহসানউলস্নাহ মাস্টারের মতো জনপ্রিয় নেতা ও সাংসদদের হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় খুলনার জনপ্রিয় আওয়ামী নেতা মঞ্জুরুল ইমামকে। এমনকি আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া সরকার নয়টি দুর্নীতির মামলা সাজান। তার মধ্যে সাতটি আইনি প্রক্রিয়াতেই উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। দু'টি মামলায় উপযুক্ত উপাদান না থাকায় অভিযোগ গঠন করা যায়নি এবং তা অকার্যকর হয়ে যায়। উলেস্নখ্য, ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছয়টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে দু'টি আদালতে নির্দোষ নিষ্পত্তি হয়। বাকি চারটি চাঁদাবাজি মামলা বাদী অনুতপ্তবোধে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তুলে নেন। অর্থাৎ প্রমাণিত হয়েছিল যে, সেগুলো ওই ফখরুদ্দিন সরকারেরই বহুল সমালোচিত 'মাইনাস টু' ফর্মুলার গভীর কুরাজনৈতিক দুরভিসন্ধিরই অংশবিশেষ। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে বিচারালয়ে বোমা হামলা, বিচারক ও আইনজীবী হত্যা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে বোমা হামলা, ব্যাপক সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি বর্বরতার দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মদতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় সরকারেরই মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন জেএমবি কর্তৃক একযোগে সিরিজ বোমা হামলার মাধ্যমে দেশকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়াও, এনএসআই, ডিজিএফআইয়ের মতো রাষ্ট্র্রের সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর ইন্টেলিজেন্স বিভাগকে অপব্যবহার করে ভারতে ১০ ট্রাক অবৈধ অস্ত্রের চালান সরবরাহ চেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বলয়ে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র্রের তকমা লাগানো হয়। অর্থাৎ, বলা যায়, ২০০১-০৬ সালের বিএনপির শাসনামল নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এক বিভিষীকাময় অধ্যায় হিসেবে সূচিত হয়ে আছে। এছাড়া '৯৫ পরবর্তী বিএনপি কর্তৃক জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি, খালেদা জিয়া কর্তৃক জাতির পিতা, জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ও শহীদদের সংখ্যা বিকৃতির মাধ্যমে জাতীয় চেতনাতে আঘাত ও বিভাজন সৃষ্টি- এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির এককেটি ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তবে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক (রহঃবষষবপঃঁধষ) দুর্নীতির পুরোধা ছিলেন জিয়াউর রহমান। '৪৭ পরবর্তী পূর্ববাংলায় বঙ্গবন্ধু মননশীল রাজনীতির যে সৃষ্টিশীল বীজবপন করেছিলেন, '৭১ পরবর্তী সময়ে তার সুমহান নেতৃত্বে সেটার সুশোভন প্রস্ফুটন বিরাজমান ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর '৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়ার ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্রে রাজনীতির সেই ধ্রম্নপদী (পষধংংরপধষ) তথা শৈল্পিক (ধৎঃরংঃরপধষ) ধারা নস্যাৎ হয়ে যায়। যেমন- রাতের আঁধারে সমরাস্ত্রের জোরে অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রকে হত্যা, কথিত ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে শত শত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সামরিক সদস্যদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশ ও মানবাধিকারের চরমতম লঙ্ঘনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে বিতর্কিতকরণ, অবৈধ হঁ্যা-না ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রোধে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ- 'বিচার' ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন, সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাদ দেওয়ার মাধ্যমে জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিপন্নকরণ, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতার গোড়াপত্তন, চার জাতীয় নেতার হত্যার বিচার রোধের মাধ্যমে দেশে প্রগতিশীল চেতনার অপমৃতু্য সাধন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন ও পুরস্কৃৃতকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উৎসাহিতকরণ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বঘোষিত স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামস গংদের রাজনীতি উন্মুক্তকরণ ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চরম অবমাননা ও রাজনীতি দূষিতকরণ, ছাত্র ও যুবরাজনীতিতে কালোটাকা ও অবৈধ অস্ত্র প্রবিষ্টের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী ছাত্র ও যুবরাজনীতি বিনষ্টকরণ ইত্যাদি। সর্বোপরি, তার বিতর্কিত রাজনৈতিক দর্শন 'ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ :যব ঢ়ড়ষরঃরপরধহং'। এর দ্বারা তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির সংস্কৃতি জন্ম দেন। এর দ্বারা তিনি সর্বত্র দুর্বৃত্তায়নের মনস্তত্ত্ব গ্রথিত করে গেছেন, যার ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতিসহ তাবৎ সেক্টর এখন নষ্টেভ্রষ্টে পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
পরবর্তী সময়ে জিয়ার দেখানো পথে এরশাদও রাতের আঁধারে সশস্ত্র বলে ক্ষমতা দখল করেন। সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক তথা সর্বজনীন মানবিক চেতনায় আঘাতের মাত্রা তিনি জিয়ার চেয়ে আরও বেগবান করে তোলেন। জিয়ার সৃষ্ট প্রায় সব দুর্নীতি তিনিও অনুসরণ করেন। বিশেষ করে জাতিসত্তা বিরোধী ও ইতিহাস বিকৃতিমূলক এমন বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ঘৃণ্যতা জিয়া, এরশাদ ও খালেদার মতো আর কোনো নেতা (?) ও সরকারের আমলে দেখা যায়নি।
প্রসঙ্গত, আওয়ামী সরকারের আমলে তাদেরই সংঘটিত অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিচার তাদের দ্বারাই যতটা কার্যকর হয়েছে এবং হতে যাচ্ছে তা বিগত কোনো সরকারের আমলে এমন আত্মশুদ্ধির চেষ্টা দেখা যায়নি, যা নিরপেক্ষ ও নির্মোহ পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়। দুর্নীতি দমন কর্তৃপক্ষকে আওয়ামী আমলের মতো কখনোই এতটা সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। তাই আওয়ামী সরকার এ ক্ষেত্রে নিন্দার পাশাপাশি প্রশংসারও দাবি রাখে বললে অতু্যক্তি হবে না।
পরিশেষে, দুর্নীতি একটি জাতীয় অভিশাপ। তাই সদ্যপ্রসূত বাংলাদেশে যাতে দুর্নীতির শেকড় না গজাতে পারে সে জন্য বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তার শাসনামলে দুর্নীতিই তাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ আজো ইতিহাসে দলিল হয়ে আছে, কিন্তু দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী গং তাকে বেশি দূর এগোতে দেয়নি।
অথচ তার অতিসাধনায় সৃষ্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুর্নীতিতে আজ যেভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, তা সত্যিই দুর্ভাগ্যের এবং হতাশার! এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিদারুণভাবে আঘাত করে। হৃদয় রক্তাক্ত করে বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের। তবে আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে, জাতিসত্তা বিরোধী ও ইতিহাস বিকৃতির মতো বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি সবচেয়ে ভয়ংকর- যা অন্য সব দুর্নীতিকে প্রভাবিত ও বেগবান করে এবং যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী দেশ ও জাতিকেও অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারে! তাই এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও আমাদের সর্বদা সজাগ ও সোচ্চার হতে হবে। শুধু অনুশাসন ও প্রশাসন দিয়ে সর্বপ্রকার দুর্নীতি কমবেশি সাময়িক দমন করা যায়, কিন্তু যথার্থ নির্মূল করা যায় না। নির্মূল করতে প্রয়োজন মনুষ্যত্ববোধে গড়া স্বদেপ্রেম।
কাজী মাসুদুর রহমান : কলাম লেখক