দেশের সরকারি দপ্তরগুলোতে দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করেছে। অবস্থা দৃষ্টিতে মনে হয়, কে কত দুর্নীতি করতে পারে এই প্রতিযোগিতাই নেমেছে সরকারি কর্মী বাহিনী। সরকারি কর্মীদের কোনো ভয় নেই, দুর্নীতি করছে। আবার ধরা পড়ছে ধরা পড়ার পর দুর্নীতির পাহাড়সম টাকায় নিয়ে বিনা বাধায় দেশ ত্যাগ করে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছি। সিনিয়র সচিব থেকে নাইট গার্ড পর্যন্ত যে যার অবস্থানে অবলীলায় করছে দুর্নীতি। কারণ, ধরা পরলে তো বিদেশ পালানোর ব্যবস্থা আছেই। ধরা যখন পড়ছে তখন বুঝা যায়, কি পরিমাণ দুর্নীতি হচ্ছে দেশে তাই পর্দার আড়ালে পাহাড়সম দুর্নীতি আর দৃশ্যমান হয় না। একটি প্রবাদ আছে, এক হাতে তালি বাজে না, ঠিক তেমনি একজন সরকারি কর্মী তার কলিগ, বস বা অন্য কোনো সরকারি কর্মীর সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতি করতে পারে না। তার উদাহরণ বেনজীর। কারণ বেনজীর দেশ ত্যাগ করে চলে গেলেন। বেনজীর যে দেশ ত্যাগ করতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব ছিল সরকারি কর্মীদেরই। কিন্তু তা তারা দেখেননি। তাদের কারো না কারো সহযোগিতায় বেনজীর দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছে। রাজস্ব বোর্ডের সদস্য সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মী তাকেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি হলেন জনালোচিত মতিউর। দেশের জনগণের দেওয়া রাজস্ব দিয়ে দেশে এতসব গুয়েন্দা, ডিবি, সিআইডি, পিবিআই পোষা হচ্ছে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মতিউর বেনজীরের ন্যায় উদাও। বিষয়টি ভাবতে অবাক লাগে। দেশের একজন নিরীহ মানুষকে মাটির নিচ থেকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী খুঁজে বের করতে পারে কিন্তু মতিউরকে পাচ্ছে না তারা খুঁজে। বেচারা মতিউর মহান পবিত্র কোরবানি কর্মকান্ডে ফেঁসে গেলেন। কোরবানি দেওয়ার জন্য স্বযত্নে (অসুদপায়ে আয় করা) জমানো প্রিয় টাকা দিয়ে ছাগল কেনার পর দুষ্ট ফেসবুক ইউজারা তাকে ফাঁসিয়ে দিল। তার প্রিয়তম ছেলের কেনা কোরবানির ছাগলটি ফেসবুক ব্যবহারকারীরা ভাইরাল করে দিল আর তাতেই হলো কাল। এই ভাইরালের পর বেড়িয়ে এলো থলের কালো বেড়াল। তার অঢেল সম্পদ আর টাকা কড়ির খবর ছড়িয়ে পড়ে লোকমুখে। তার মেয়ে, দুই স্ত্রী, কথিত আছে বেশ কিছু বান্ধবীরদের কাছে রয়েছে মতিউরের কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার এক স্ত্রী জনপ্রতিনিধি, তিনি রায়পুরা (নরসিংদীর) উপজেলা চেয়ারম্যান। এই মহিলা সরকারি গাড়িতে চড়েন না। তিনি কোটি টাকা দামের নিজের কেনা গাড়ি ব্যবহার করেন। তিনি অনেক সাহসী। আসলে টাকা হলে সাহস বাড়ে এ কথা সত্য। তাই তিনি মতিকান্ডের পর নরসিংদীতে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে সব গণমাধ্যম মেনেজ করে এসেছি। সুতরাং, এখন কেউ কিছু বলতে পারবে না তাকে। তিনি মতিউরের বিরুদ্ধাচারণ করেন সংবাদ সম্মেলনে। এটাও মতিউর নাটকের আরেকটি দৃশ্য। ছাগলকান্ডের পর বেরিয়ে আসে সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের ঘটনা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মাদপুরে রামচন্দ্রপুর খালের ত্রিশ বিঘায় গড়ে ওঠেছিল সাদিক অ্যাগ্রো। সাদিক অ্যাগ্রো এই জায়গায় অবস্থান করছে র্দীঘ ২০ বছর ধরে। এক বিঘা মানে ১৬০০ বর্গগজ ৩০ বিঘা মানে ১০ একর প্রায় ৪৮ হাজার বর্গগজ। এই জমি মালিক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। প্রায় দুই যুগ ধরে সাদিক অ্যাগ্রো এই বিশাল আয়তনের জায়গাটা দখল করে আছে। এত বড় জায়গাটা সরকারি কর্মীদের দৃষ্টিগোচর হয়নি ২০ বছরে একবার। তা কারো নজরে পড়েনি। মতিউরের ছেলে যদি ছাগল না কিনত আর এই ছাগল যদি ভাইরাল না হতো তাহলে হয়তো এই জমি উদ্ধারের সম্ভাবনাও ছিল না। কারণ বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যেত। এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলত না। প্রশ্ন হচ্ছে, সাদিক অ্যাগ্রো এমনি এমনি এই জায়গা ব্যবহার করে আসছিল। ডিএনসিসির কোনো কর্মীর সহযোগিতা না পেলে সাদিক অ্যাগ্রো এখানে গড়ে উঠতে পারত না। সাদিক অ্যাগ্রো ফার্মের কি কোনো নিবন্ধন আছে? বা ট্রেড লাইসেন্স আছে কি? কোনো কর্তৃপক্ষ এর নিবন্ধন দিয়েছেন? কোন কাগজমূলে এই অ্যাগ্রো ফার্মটি রাজধানীতে ব্যবসা করে আসছে, তার সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বক্তব্যটাও গণমাধ্যমে আসা প্রয়োজন। কেন কীভাবে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ সরকারি জমি সাদিক অ্যাগ্রো ব্যবহার করল তার রহস্যটা উন্মোচন করা দরকার। যাদের সহযোগিতায় এই জায়গাটা সাদিক অ্যাগ্রোর দখলে গেল তাদের তালিকাটাও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা উচিত। আর কত এ রকম জমি আছে- যা সরকারি কর্মীদের সহযোগিতায় দুর্নীতির মহাআখড়া গড়ে উঠেছে তারও একটি তালিকা অনুসন্ধান করে প্রকাশ করা হোক। সরকারি রাজস্ব বোর্ডের আরেক কর্মী দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে ছড়িয়েছে। তিনি হলেন কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল। তাকে ফয়সাল মিঞা বলে সম্বোধন করলাম। তিনি রাজস্ব বোর্ডের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস অ্যান্ড লিগ্যাল এনফোর্সমেন্ট)। তার কাছ থেকে যেভাবে সম্পদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তিনি চাকরিকালীন সময় আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন। ২০১৯-এর জুন থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ফয়সাল মিঞা তার ও তার পরিবারের নামে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ২০১৯-এর জুন থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর মোট ২৯ মাস। এই সময়টায় ফয়সল মিঞা গড়ে প্রতি মাসে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন সাড়ে ১৪ লাখ টাকার। ফয়সাল মিঞার মাসিক বেতন যদি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা করে হয় তাহলে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা হতে সময় লাগবে ১৭০ মাস (শুরু থেকে তার বেতন দেড় লাখ টাকা করে ছিল না, তিনি যখন রাজস্ব বোর্ডে একজন কর্মী হিসেবে যোগদান করেন তখন তার বর্তমানে স্কেলে বেতন ছিল সর্বসাকুল্যে ৩৮ হাজার টাকা। এই স্কেলটা তার যোগদানের সময় অনেক কম ছিল) এই ফয়সাল মিঞাই আবার ১২ নভেম্বর, ২০২০ সাল থেকে ২১ সালের ১০ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত আরও ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। এই কথাগুলো এখানে বলার কারণ হলো, তিনি যখন এতগুলো টাকার সঞ্চয়পত্র কেনেন তখন কি কেউ তার টাকার উৎসটা কি জানতে চেয়েছিলেন। যারা সঞ্চয়পত্র ফয়সাল মিঞার কাছে বিক্রি করল তাদের কি কোনো দায় নেই। এ ছাড়া আরও সম্পদ আছে ফয়সাল মিঞার, বিভিন্ন তদন্তে এই ফয়সালের আরও প্রায় ২০ কোটি টাকার নামে-বেনামে সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। সরকার ঠিকাদারি সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য ই-টেন্ডার চালু করেছেন। এর ফলে কি সিন্ডিকেট বন্ধ হয়েছে। এখন কাজ কেনা-বেচার নামে গড়ে উঠেছে মহা সিন্ডিকেট। শিক্ষা প্রকৌশলের কাজ বিক্রি করে দেওয়ার জন্য প্রকৌশলীরা চাপ দিচ্ছে প্রান্তিক ঠিকাদার ও নতুন ঠিকাদারদের। যদি কাজ বিক্রি না করে তাহলে তার অনেক টাকা লস হবে বলে প্রকৌশলীরা জানিয়ে দেন। কারণ হলো কাজ বিক্রি না করলে প্রকৌশলী কড়ায়গন্ডায় কাজের তদারকি করবেন, ফলে ঠিকাদারের লস খেতে হবে। এ ধরনের হুমকি দিয়ে লটারিতে কাজ পাওয়া নতুন ঠিকাদারদের বাধ্য করে উপসহকারী প্রকৌশলীরা পাওয়া কাজটি বিক্রি করতে। প্রতিটি কাজের ওয়ার্ক অর্ডার ও বিলে প্রায় ৫ শতাংশ টাকা (মোট বিলের ওপর) প্রকৌশলীদের ঘুষ দিতে হয়। প্রকৌশলীরা বিভিন্ন টাইলস কোম্পানি, ইটের ভাটা ও অনান্য নির্মাণ উপকরণ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেলামি নেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব উপকরণ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের উপকরণ ব্যবহার করার জন্য তারা ঠিকাদারিকে নির্দেশ দেন। ট্রেজারিতে যে কোনো সরকারি চেক আনতে গেলে প্রতি লাখের ওপর একটি টাকা ট্রেজারি কর্মীদের দিতে হয়। এটা অলিখিতভাবে ধার্য করে দেন ট্রেজারির কর্মকর্তারা। এভাবেই চলছে প্রকাশ্যে ঘুষের লেনদেন। সরকারি কর্মীরা শুধু ফাঁক খুঁজেন কীভাবে অবৈধ সম্পদ উপার্জন করা যায়। দেশটা আজ মহাহরিলুটের ভান্ডারে পরিণত হয়ে গেছে। সরকারি কর্মীরা যে যেভাবে পারছে করছে দুর্নীতি। যে সব দপ্তরে অবৈধ আয়ের পথ কম তারাও ফাঁক বের করে দুর্নীতি করে নিচ্ছেন। যেমন ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা ট্রেনিং নিয়ে করেছেন দুর্নীতি। তিনি ট্রেনিংয়ের টাকা পকেটস্থ করতে অন্য উপজেলায় বসবাসরত নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়স্বজনের নাম ট্রেনি হিসেবে দেখিয়ে ট্রেনিংয়ের টাকা আত্মসাৎ করেন। এই দুর্নীতির ব্যবস্থাটা কে রোধ করবে। সরষেতে রয়েছে ভূত। কারণ দুদক, এনবিআর, প্রশাসন ও পুলিশসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এখন দুর্নীতি করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কোমড় বেঁধে। তাই দুর্নীতি দিন দিন বাড়ছে।
সরকারের এই দুর্নীতি রোধ করতে হলে সুশীল নয় সাধারণ জনগণ দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। আমজনতার রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে তার কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক