শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

অসৎ উপায়ে জীবনযাপনের চেয়ে নির্মোহ শান্তিপূর্ণ জীবন অধিক গুরুত্বপূর্ণ

সাম্প্র্রতিক সময়ে অনেক পিতা-মাতার অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা-পয়সায় সন্তানরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। এজন্য অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের চেয়ে সুসন্তান ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
মো. জিলস্নুর রহমান
  ০২ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
অসৎ উপায়ে জীবনযাপনের চেয়ে নির্মোহ শান্তিপূর্ণ জীবন অধিক গুরুত্বপূর্ণ

সম্প্র্রতি ছাগলকান্ডে একজন কর কর্মকর্তার অবৈধ উপায় অর্জিত অর্থ সম্পদ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইতোমধ্যে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থবিত্তে তার ছেলেমেয়েসহ পুরো পরিবারের আয়েশি জীবনযাপনের খবর অনেককেই বিস্মিত ও হতবাক করেছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে শুধু এ কর্মকর্তাই নন, তার মতো অনেকেই বেপরোয়া জীবনযাপন করছে বলে গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা স্বামীর কিংবা সন্তানরা পিতার কথামতো কাগজে সই করেই সম্পদের মালিক হয়ে যান, অর্থ সম্পদের সব হিসাব পরিচালনা করে সংসারের কর্তা-ব্যক্তি স্বামী বা পিতা। ফলে স্বামী বা পিতার অবৈধ সম্পদ বা আয়ের উৎস স্ত্রী-সন্তানের কাছে জানতে চাইলে বেশিরভাগ স্ত্রী-সন্তানরা সদুত্তর দিতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী বা পিতাকে বাঁচানোর জন্য নীরব থাকতে বাধ্য হন এবং নিজেও শাস্তি ভোগ করেন।

দেখা যায় এ ধরনের অসৎ কর্মকর্তারা স্বাভাবিক বা বৈধ পথে নয়, অবৈধভাবে অনেকেই প্রচুর সম্পদ, বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে যান। দেখা যায় অনেকেই আয়বহির্ভূত এসব অর্থসম্পদ রাখেন স্ত্রী-সন্তানের নামে। গোপনে সম্পত্তিও কেনেন স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যদের নামে। দুর্নীতির অপরাধে কখনো এসব প্রকাশ পেলে স্বামী বা পিতার সঙ্গে তাদের নামও চলে আসে। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতি বা সেই অপরাধের ব্যাপারে স্ত্রী বা সন্তানদের কোনো ভূমিকাই থাকে না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবৈধ আয় সম্পর্কে জানার পরও স্ত্রী বা সন্তানরা প্রতিবাদ করতে পারে না কিংবা স্ত্রী বা সন্তান স্বামী বা পিতার ঢাল হয়ে ওঠে, তাদের কিছুই করার থাকে না।

পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা। সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে না পারা মা-বাবার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তাই সন্তানকে যোগ্যতর মানবসন্তান হিসেবে, দেশের যোগ্যতর নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা মা-বাবার মানবিক, নাগরিক দায়িত্ব। সন্তানের বিপথগামিতার জন্য অসৎ মা-বাবাও অনেকাংশে দায়ী। কারণ তাদের মেধা-মনন, আয় উপার্জন, স্বভাব-চরিত্র, আচার-ব্যবহার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তাদের সন্তানের জীবনের সার্বিক বিকাশ সাধিত হয়। এজন্য সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা মা-বাবাকে তার শৈশবেই গ্রহণ করতে হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শৈশব জীবনের প্রভাতবেলা। এই সময় শিশুর প্রবৃত্তি, প্রবণতা- সবকিছুকেই অঙ্কুরিত অবস্থায় দেখা যায়। তাই শৈশবকে বলা হয় গাঠনিক কাল। কাঁচা মাটির মতো শৈশবকে শিক্ষকরা ও গুণীজন ইচ্ছামতো ঢেলে সাজাতে পারেন, যা কঠিন মাটিতে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে পিতামাতাই যদি অসৎ হয়, তবে সেটা বাস্তবায়ন করা কঠিনই বটে!

অনেক সময় স্ত্রী-সন্তানের অজান্তেই এ ধরনের অনৈতিক অপরাধ সংঘটিত হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রী-সন্তান এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানে ও তাদের পূর্ণ সম্মতি থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য তারা চাইলেও প্রতিবাদ করতে পারে না কিংবা সম্পদের মোহে পড়ে কিছুই করার থাকে না। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ আয় ও সম্পদের দায় অনেক ক্ষেত্রেই বিনাদোষে নারী বা সন্তানের ওপর বর্তায়। যদি দোষ না-ও থাকে ওই অবৈধ আয় ও সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য স্ত্রী-সন্তানকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অর্জিত সম্পত্তি নিজের নামে না রেখে পরিবারের অন্য সদস্য বা স্ত্রীর নামে রাখার কৌশল অবলম্বন করা আইনের চোখে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্ত্রী-সন্তান জানুন বা না জানুন। মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পদ গোপন করা বা লুকানোর উদ্দেশ্যে সম্পদের রূপান্তর বা হস্তান্তর করা হয়।

সন্তান বিকৃত চরিত্রের ও অপরাধপ্রবণ হয় মা-বাবার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। এমনকি সন্তানের বিবেকের বিকৃতিও মা-বাবার কারণে ঘটে। মা-বাবা তাকে সমাজের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে যেমনটি শিখিয়েছেন, সেই বোধ নিয়েই গড়ে ওঠে তার বিবেক। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সন্তানের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা সৃষ্টির কারণ হলো প্রথমত মা-বাবার আচরণ প্রত্যক্ষভাবে ছেলেমেয়ের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত। অতিরিক্ত শাসন, অতি আদর, অতি অবহেলা শিশুকে করে তোলে অপরাধী। শাসনের বাড়াবাড়ি শিশুর কোমল মনে বিদ্রোহের সঞ্চার করে এবং তার সুষ্ঠু বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করে। শৈশবে ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো যদি তৃপ্ত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে শিশু অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, মা-বাবা যদি দুর্নীতি করেন ও অসৎ অর্থ উপার্জন করেন কিংবা মাতাল, লম্পট হন, এর প্রভাব ছেলেমেয়েদের ওপর পড়ে। তারাও বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, পারিবারিক অশান্তির মধ্যে ভগ্ন পরিবারকেই অপরাধপ্রবণতার প্রধান কারণ ধরা হয়।

দাম্পত্যজীবন হলো মানবজীবনের মূল পর্ব এবং শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করাই চূড়ান্ত লক্ষ্য। যেখানে রয়েছে সাংসারিক জীবনের দায়দায়িত্ব এবং সন্তান জন্ম দেওয়া ও প্রতিপালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ। কিন্তু আমাদের দেশের নবদম্পতিরা বিবাহের আগে দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে নূ্যনতম জ্ঞান লাভের সুযোগ পায় না। দু'টি ভিন্ন পরিবার ও পরিবেশে বেড়ে ওঠা যুবক-যুবতী, যারা যৌবনের উচ্ছলতায় এতদিন বিভোর ছিল, যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে সকাল-সন্ধ্যার আগমন-প্রত্যাগমনের হিসাবটাও ঠিকমতো রাখত না, তাদের বৈবাহিক বন্ধনে বেঁধে দিয়ে অভিভাবকরা তৃপ্তির ঢেঁকুড় তোলেন। আর এদিকে ভিন্ন অভ্যাস, প্রকৃতি, রুচি, চিন্তা ও সংস্কৃতি থেকে আসা দুটি জীবন একত্রীকরণের এক কঠিন পর্বে অবতীর্ণ হয়ে পরিবারের অন্যদের প্রত্যাশার চাপে এক মহাদুর্বিপাকে পড়ে যায়। ফলে বেশিরভাগ পরিবারে দাম্পত্য কলহ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় তাদের ঘরে সন্তান এলে সেই সন্তানকে আদর্শিক মানদন্ডে গড়ে তোলা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়ে ওঠে না। আদর্শহীন, জীবনের লক্ষ্য হতে বিচু্যত, হতাশাগ্রস্ত ওইসব মানবসন্তান যখন যৌবনে পদার্পণ করে, তখন স্বাভাবিক কারণেই তাদের দিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে। সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বিবাহ করবে, তাদের মা-বাবা হতে হবে- তাই তার মধ্যে মাতৃত্বের ও পিতৃত্বের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা মা-বাবার দায়িত্ব। এজন্য সুসন্তান পেতে হলে অবশ্যই মা-বাবাকে সৎ হতে হবে।

মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠনে পারিবারিক সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত মায়ের কোলে শিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি। পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। সন্তানের মূল্যবোধ, চরিত্র, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। বাবা-মা যেমন আদর্শ লালন করেন, তাদের সন্তানরাও সেটা ধারণ ও লালন করার চেষ্টা করে। পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের মতো যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম। কিন্তু এক্ষেত্রে পিতা-মাতাই যদি অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনে অভ্যস্ত হয়, নীতিনৈতিকতাহীন জীবনযাপন ও অর্থবিত্তে গা ভাসিয়ে দেয়, তবে সেক্ষেত্রে সুসন্তান ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন আশা করা দুরূহ বটে।

বহু মা-বাবা ও অভিভাবক আছেন সন্তানের জন্য অনেক কিছু করেন। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বেহিসেবি খরচ করে কিন্তু তাদের সন্তানের চরিত্র গঠনের দিকটিকে একেবারে উপেক্ষা করে যান। মোটেও গুরুত্ব দেন না। নিজেদের বেপরোয়া জীবনযাপন করতে দেখে ছেলেমেয়েও সেটা দেখতে অভ্যস্ত। গতানুগতিক ও আধুনিকতার কথা বলে নিজেদের মতো ছেলে মেয়েদেরও ধর্মের কাছে ঘেঁষতে দেন না! ফলে এর প্রভাব পড়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি বাঁকে। চরিত্র বিধ্বংসী সব কাজকে তারা আগলে নেয়। জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক সব কর্মকান্ডে। চরিত্র গঠনের জন্য তাই পিতা-মাতার মতো সন্তানদেরও ধর্মীয় বিধিবিধান ও পুস্তকাদি অধ্যয়ন করা দরকার। ব্যবহারিক জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে খুবই জরুরি। এজন্য চরিত্র গঠনে পরিবারের সবার ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রতিটি বাবা-মাই তার সন্তানকে ভালোবাসেন- এতে কোনো দ্বিমত, সন্দেহ নেই। তবে সঠিকভাবে বাচ্চা লালন-পালন করা, তাকে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে শিক্ষা দেওয়া, সঠিক পথে পরিচালিত করা প্রতিটি পিতা-মাতার দায়িত্ব। এজন্য বাবা-মায়ের যথেষ্ট চিন্তা, পড়াশোনা, প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ ও আন্তরিক ধৈর্য ধারণ প্রয়োজন। আমরা যেমন চাকরি করি, ব্যবসা করি অধিক মনোযোগ ও সময় দিয়ে, সন্তান লালন-পালনও তেমনি চাকরি বা ব্যবসার মতো মনোযোগ ও সময় দাবি করে। সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সবার আগে প্রয়োজন আদর্শ অভিভাবক ও অনুকূল পরিবেশ। কিন্তু পিতা-মাতা যদি অসৎ ও নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ হন, তবে সুসন্তান আশা করা দুরূহ বটে। একজন লোক একাধিক বিয়ে ও সন্তান জন্মদান করতেই পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই যদি সে সৎ উপায়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয় কিন্তু সেটা যদি অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা-পয়সায় গা ভাসিয়ে দেয়, সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয় ও উদ্বেগের কারণ। এ কারণে সাম্প্র্রতিক সময়ে অনেক পিতা-মাতার অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা-পয়সায় সন্তানরা বিপথে পরিচালিত হচ্ছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। এজন্য অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনের চেয়ে সুসন্তান ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

মো. জিলস্নুর রহমান : ব্যাংকার ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে