বাংলাদেশে ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। মোট এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এবং আগের বছরের চেয়ে বেড়েছিল ২০ শতাংশ। দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা উদ্বেগজনক। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ রিপোর্টে দেশওয়ারি বিদেশি বিনিয়োগ আসার এবং অন্য দেশে বিনিয়োগ করার ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশে বছর শেষে মোট বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ বা স্থিতি কমে গেছে। ২০২২ সালেও আগের বছরের চেয়ে এফডিআই স্থিতি কমে যায়। এর মানে বাংলাদেশ থেকে গত দুই বছরে উলেস্নখযোগ্য অংকের বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। আগের বছর যা ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগের কয়েক বছর এফডিআই স্থিতি বাড়ছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের সর্বাধিক বিনিয়োগ এসেছিল। বাংলাদেশে অবশ্য ২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) জন্য অর্থের ঘোষণার পরিমাণ বেড়েছে- যা ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ২৮৯ কোটি ডলার। ২০২২ সালে যা ছিল মাত্র ৬৫ কোটি ডলার। বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের ঘোষণা আগের চেয়ে গত বছর বেড়েছে। সরকার সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে চায়। তাতে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান ও অতিরিক্ত চার হাজার কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি আশা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। তবে সর্বশেষ তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৪২০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৩ হাজার মানুষের। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নে ধীরগতি থাকায় ১০০টি অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে কেন বিদেশি বিনিয়োগ কমল? বাংলাদেশে এফডিআই আগে থেকেই নিম্নস্তরে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই পরিমাণ জিডিপির দেশ ভিয়েতনামে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে এফডিআই এসেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন- যা তাদের জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশের সমান। যে কোনো দেশের জন্য শক্তিশালী এফডিআই আকর্ষণে তিনটি বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। একটি দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই স্থাপিত হয়, যখন ট্রেডমার্ক, আইপিআর ও এডিআর সংক্রান্ত নিয়মকানুন ন্যায়সংগত ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়; আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং কোম্পানিগুলো তাদের পরিষেবার জন্য নির্বিঘ্নে অর্থপ্রাপ্তি ও মুনাফা প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পায়। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো নীতির ধারাবাহিকতা। এমন এক ধরনের নীতি থাকতে হয়- যা আকস্মিক পরিবর্তন হয় না। প্রতিশ্রম্নত কর ছাড় বা আমদানি-রপ্তানি সুবিধা হঠাৎ বাতিল হয় না। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয় না এবং যে কোনো প্রণোদনা বৈষম্য ছাড়াই সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়। তৃতীয় বিষয়টি হলো সামর্থ্য, অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করা, তাদের যত্ন নেওয়া এবং ভ্যাট কাঠামো সহজ করে তোলা, পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর অধিক জোর দেওয়া, কার্যকর আয়কর কম রাখা এবং একটি ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পদ্ধতি। বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ও বিনিয়োগ স্থিতি দুটোই কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। এর মানে নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণ এবং যারা আছে তাদেরও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাফল্য কম। কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু পুরনো আইনকানুনের সংস্কার করা হয়নি। এ ছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ, সবাই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে গত বছর একটি কর্মসূচি চালু করেছে। এর আওতায় দ্রম্নত বিভিন্ন সংস্কার করা গেলে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হবে। এরই মাঝে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শোনা গেল একটি সুসংবাদ। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আলপেন বানিয়ান গার্মেন্টস বিডি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৯০ হাজার বর্গমিটার জমির ওপর একটি পোশাক কারখানা স্থাপন করবে; যেখানে বার্ষিক ৪ কোটি ৩০ লাখ পিস ওভেন ও নিট পোশাক প্রস্তুত হবে। পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন শুরু হলে প্রতিষ্ঠানটিতে ১১ হাজার ৯৯৫ বাংলাদেশি নাগরিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিই প্রস্তাবিত সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বিনিয়োগ গন্তব্য হিসেবে নির্বাচনের জন্য আগামী দিনগুলোতে আরও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বেছে নেবেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এবং প্রত্যাশা করি। তৈরি পোশাক এবং টেক্সটাইলসহ সব খাতকে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য স্বাগত জানায়। অটোমোবাইল, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্সসহ আইটি পণ্যের মতো বৈচিত্র্যময় খাতের আরও বেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে স্থাপিত বেপজার সর্ববৃহৎ উদ্যোগ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য বেপজা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছে। আলপেন বানিয়ান গার্মেন্টসসহ মোট ২৯টি প্রতিষ্ঠান বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করল, যাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ মোট ৬৮৮ মিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় পণ্য যেমন, ফুটওয়্যার ও ফুটওয়্যার এক্সেসরিজ, টেন্ট এবং ক্যাম্পিং ইকুইপম্যান্ট, হেয়ারকেয়ার প্রোডাক্ট ও এক্সেসরিজ, লুব্রেকেটিং ওয়েল, ডিসপোজেবল কাটলারি ইত্যাদি উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানসমূহ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৩টি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করেছে এবং এ বছরের মধ্যে আরও ৩টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি শুরু করবে মর্মে আশা করা হচ্ছে।
দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করলে ১০ বছর কর অবকাশ সুবিধা মিলবে, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি পাওয়া যাবে। সরকারের কাছ থেকে এ রকম বেশ কিছু প্রতিশ্রম্নতি পাওয়ার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্র্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেওয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছে। এক প্রজ্ঞাপনে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের কথা জানায় এনবিআর। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে এত দিন শুল্ক অব্যাহতিসহ নানা সুবিধা ছিল। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূলধনি যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এত দিন সব ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আয়কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এবার সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল ছাড়া অন্য সব অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর আয়কর আরোপ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা পণ্য আমদানিতেও এত বছর শুল্ক অব্যাহতি ছিল। সে ক্ষেত্রে নতুন বাজেটে ১ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ইজেডে স্থাপিত ওয়্যারহাউসের অনুকূলে এত দিন দেওয়া বন্ড সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিয়োজিত বিদেশি কর্মীদের প্রথম তিন বছরের আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর অব্যাহতি ছিল। সেটি বাতিল করা হয়েছে। সরকারের সুবিধা প্রত্যাহারের এই ঘোষণায় দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে দেশি-বিদেশি অন্তত ৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ শঙ্কায় পড়বে। এর ফলে, উদ্যোক্তারা বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবেন কিনা, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) সুবিধা প্রত্যাহারের সমালোচনা করেছে। সুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশে আর বিনিয়োগ করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই আশঙ্কায় দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যেতে পারে। বর্তমান সুবিধাগুলো না থাকলে উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করবেন। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত অনেকটা 'গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার' মতো। এতে দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে যাবে। পাশাপাশি নতুন বিনিয়োগ আসার পথও রুদ্ধ হবে। শিল্পায়নের জন্য দরকার নীতির ধারাবাহিকতা। সেটি না থাকলে কেউ বিনিয়োগে আস্থা পাবেন না। কর বাবদ কিছু বাড়তি টাকা পেতে সরকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে। তাদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেওয়া আটটি সুবিধা প্রত্যাহারের ব্যাপারে এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চেয়ে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের প্রবণতা বেশি। এ জন্য সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তা ছাড়া শুল্ক অব্যাহতির অপব্যবহার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছু খাতে দুই বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কর অব্যাহতি কমিয়ে আসছে এনবিআর। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সম্মিলিতভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে। অন্যদিকে, গত তিন বছরে এসব সুবিধা দেওয়ায় সরকার ৫০০ কোটি টাকার কম রাজস্ব হারিয়েছে। বেজার সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই এনবিআর ইজেডের সুবিধা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে এনবিআর দু'টি আইন ভঙ্গ করেছে। প্রথমত, কাস্টমস আইনের ২৬২ নম্বর ধারায় বলা আছে, আইন ও বিধি বাস্তবায়ন সম্পর্কিত বিষয়ে সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি খাতের কাছ থেকে নিয়মিত পরামর্শ নেবে। দ্বিতীয়ত, ইজেডে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকারীদের কী কী সুবিধা দেওয়া হবে, তা বেজার আইনের ১০, ১১ ও ১৩ নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে। যে কোনো নীতির ধারাবাহিকতা থাকা দরকার। নতুন সিদ্ধান্তে বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদেশিরা উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অনেক দেশীয় উদ্যোক্তার মধ্যেও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগ শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কোম্পানির বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে এখন কেন তা প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছেন তারা। সরকারের সিদ্ধান্তে দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বেজা কার্যালয়ের সামনে বড় করে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। তাতে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কী কী সুবিধা দেওয়া হয়, তা বিস্তারিতভাবে বলা আছে। অথচ সেসব সুবিধা নিশ্চিত করার বদলে উদ্যোক্তার মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ, শুল্ক অব্যাহতিসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার আশায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। মাঝপথে হঠাৎ করে এভাবে শুল্ক আরোপ হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়বেন। বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। সরকারের কাছ থেকে এসব সুবিধা না পেলে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবেন- যা দেশের শিল্পায়নে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। দেশে গত এক যুগ ধরে বার্ষিক বিদেশি বিনিয়োগ ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারের বারবার নীতিকৌশল পরিবর্তনে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে বিদেশি বিনিয়োগ আনা হয়েছিল। এখন সেসব সুবিধা বাতিল করায় উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেউই এখন বিশ্বাস করতে চাইবে না। এমন সিদ্ধান্ত সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। সুবিধা প্রত্যাহার করলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমবে। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের প্রস্তাবগুলো প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। সে জন্য বিদ্যমান সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সংজ্ঞাটি বেশ সহজই বলতে হয়। একটি জনসংখ্যাবহুল দরিদ্র দেশে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দ্রম্নত দারিদ্র্য হ্রাস। বিনিয়োগ বলতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বোঝায়, অন্যদিকে, বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আবার প্রযুক্তি হস্তান্তরও ঘটায়। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অতি আকাঙ্ক্ষিত তারল্য বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার; কলাম লেখক