একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করেছিলেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়। বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে এসেও সে নীতি থেকে একটুও সরে যায়নি। সম্প্রতি ২১-২২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর পরবর্তী নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের কূটনীতিতে ভারসাম্য নীতি বিষয়টি আবারো সামনে ওঠে আসে। আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই রাষ্ট্রীয় সফরে চীন গমনের কথা রয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। চীন না ভারত কাকে প্রাধান্য দেবে বাংলাদেশ? বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ কোনো দেশের প্রতি ঝুঁকে নেই। বাংলাদেশের কাছে সবাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতিতে আবদ্ধ। তবে ভারত-বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু তাও ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের অবদান সবকিছুর ঊর্ধ্বে তা নতুন করে বলবার কিছু নেই। আবার একইভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন এখন উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বিশ্বে দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনকেও বাংলাদেশের যথাযথ মূল্যায়ন করতেই হবে। পরিবর্তিত বিশ্বে সবকিছুই খুব দ্রম্নত পাল্টে যায় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও তার ব্যতিক্রম নয়। কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু বা স্থায়ী শত্রম্ন বলে কিছু নেই। তাই ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে দূরদর্শিতার স্পষ্ট ছাপ রাখবে বলা যায়।
বাংলাদেশের সঙ্গে যখনই ভারতের কোনো সফর, বৈঠক, চুক্তি স্বাক্ষর হয় তখন একটা বিশেষ শ্রেণির লোক অজু করে প্রস্তুতি নিয়ে বসে থাকে কখন তার সমালোচনার জিকির তুলবে। তাদের গেল গেল রব, আর দেশ বিক্রির কলরব নতুন নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, এক কোটি শরণার্থী আশ্রয়দান, মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের অংশগ্রহণ ও জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া, বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখা, তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যদের ফেরত নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো কখনই ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। এদিক বিবেচনা করলে ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। আবার একইভাবে নিকটতম প্রতিবেশী, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যসমূহের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আস্তানা হিসেবে বাংলাদেশের মাটি যেন ব্যবহৃত না হয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হিসেবেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য দিন দিন বাড়ছে যা আশাব্যঞ্জক। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গত পাঁচ দশকে এক বহুমাত্রিক পথ পাড়ি দিয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি ও জ্বালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মতো নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিস্তৃত। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যকার সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ দু'টি দেশের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উভয় দেশের এ বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও নতুন মাত্রায় নিতে আগ্রহী ভারত।
দিলিস্নর হায়দরাবাদ ভবনে শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সরকারি বৈঠকে ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) ও রূপরেখার নথি স্বাক্ষর হয়। এছাড়া বাংলাদেশের রোগীদের জন্য ইলেকট্রনিক ভিসা (ই-ভিসা) চালুসহ ১৩টি সুনির্দিষ্ট ঘোষণা এসেছে ওই বৈঠক থেকে। দুই দেশের মধ্যে রেলসংযোগ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে একটি সমঝোতা স্মারক, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য দুই সরকার একটি সমঝোতা স্মারক, ডিজিটাল পার্টনারশিপ ও টেকসই ভবিষ্যতের জন্য দুই দেশ সবুজ অংশীদারত্বের বিষয়ে দু'টি সমঝোতা স্মারক, সমুদ্রবিজ্ঞানসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) ও ভারতের বৈজ্ঞানিক ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল একটি সমঝোতা স্মারক, যৌথ ক্ষুদ্র উপগ্রহ প্রকল্পে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ভারতের জাতীয় মহাকাশ প্রচার ও অনুমোদন কেন্দ্র এবং ভারতের মহাকাশ বিভাগ একটি সমঝোতা স্মারক, কৌশলগত ও পরিচালনগত সামরিক শিক্ষায় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের মিরপুরের ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ ও ভারতের ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ, ওয়েলিংটন একটি সমঝোতা স্মারক সই এবং মৎস্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে তিনটি সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়।
বাংলাদেশের চাহিদার ক্ষেত্রগুলোতে ভারত মনোযোগী হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দারুণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে দুই দেশের বাণিজ্যকে আরও জোরদার করার সুযোগ রয়েছে।
ভারতে রপ্তানি করার মতো বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনাময় পণ্য রয়েছে, যেগুলো ভারত বিশ্বের অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। বাংলাদেশ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইসু্যগুলোর সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে আমরা প্রত্যাশা রাখছি। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে প্রশ্ন আসছে বারবার। আন্তর্জাতিক আইনি বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। ভারতের চাওয়াগুলোর বেশির ভাগ পূরণ হলেও বাংলাদেশের কিছু অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।
এখন নতুন করে আবার তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা আলোচনায় এসেছে, যেখানে ভারত ও চীন উভয়ই এ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কৌশলগত ও ভৌগোলিক দিক থেকে ভারত এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও অর্থায়নের দিক থেকে চীনের সক্ষমতা এগিয়ে থাকবে বলা চলে। তবে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর যদি তিস্তা চুক্তির জন্য আশীর্বাদ হয় তবে তা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক। কেননা, তিস্তা ইসু্যতে মমতা ব্যান্যার্জির বিতর্কিত ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের জনগণ শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও টানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এখনো তিস্তা চুক্তির আশা করছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী কূটনীতিতে বাংলাদেশ-ভারত, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক যত বেশি ভারসাম্যমূলক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিমুখী হবে, ততবেশি আমাদের দেশের জনগণের আর্থসামাজিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে। তাই কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায়ের মাধ্যমে ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার হাতকে আরো মসৃণ করবে। ত্বরান্বিত করবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন।
তানজিব রহমান : লেখক ও গবেষক