বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আবাদি জমির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষিখাত নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য কৃষির গুরুত্ব অকল্পনীয়। মৌসুমি জলবায়ুর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আবাদি জমিগুলো অনেক উর্বর। আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কৃষিজ উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেলেও তার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে দেশের জনসংখ্যা অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যাকে খাদ্য, আবাসস্থলের জোগান দিতে দিতে ব্যাপকহারে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। একদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে অপরদিকে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। যা একটি কৃষিভিত্তিক দেশের জন্য অশনিসংকেত। কিছু পরিসংখ্যান উলেস্নখ করা যাক- বাংলাদেশে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১,৬০,৫৬,৮১৬ হেক্টর যার মধ্যে আবার আবাদি পতিত জমি রয়েছে ৪.৫২ হেক্টর। সরাসরি কৃষি ক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট জনশক্তির পরিমাণ ২,৪৬,৯৩,০০০। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। কৃষির পেছনে এত জনশক্তি নিয়োগ থাকার পরও সেই খাত তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষি খাতের অবদান ১১.৫২ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও এই খাতে অব্যবস্থাপনা লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬৮ হাজার ৭০০ একর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে অর্থাৎ মোট ফসলি জমির ১ শতাংশ করে প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান হারে কৃষিজমি হ্রাস পেতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ কোনো কৃষিজমি থাকবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর ও কৃষি বিশ্লেষকরা। যা রীতিমতো বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত স্বরূপ। এ রকম পরিসংখ্যান দেখেও আবাদি জমি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহল তেমন জোরাল ভূমিকা রাখছে না। যা সত্যিই দুঃখজনক। এবার আসি আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে কৃষিজমি কমে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণই রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- গ্রামীণ এলাকায় ইটের ভাটা নির্মাণ করা, যত্রতত্র অব্যবস্থাপনামূলক কারখানা তৈরি। উলেস্নখ্য,পরিবেশ অধিদপ্তর এর তথ্যমতে, দেশে মোট ইটভাটার পরিমাণ ৯ হাজার ৭০০টি। যা বৃহৎ আকারে কৃষিজমি ধ্বংস করে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প কারখানা গড়ে তোলা, ভূমি দখল, আবাসন, চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রশিল্প, রাস্তাঘাট, রেলপথ বিনোদনমূলক প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি নির্মাণ করা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবাদিজমি এখন বিত্তশালী ও অর্থলিপ্সুদের দখলে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অধিক জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে অধিক বাসস্থান যে কারণে বাধ্য হয়ে কৃষিজমি ভরাট করে বাসাবাড়ি নির্মাণ করতে হচ্ছে। দেশের কৃষিজমির এই অপব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করতে না পারলে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না- লাখ লাখ কৃষিজীবী বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। ফলে পেশায় ট্রানজিশন ঘটবে, এতে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। উপরোক্ত কারণ ছাড়াও প্রতিবছর নদীভাঙন, বন্যা ও বিরূপ আবহাওয়াগত কারণে প্রতি বছর ব্যাপকহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজমি। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর অনেক মূল্যবান কৃষিজমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলেও অনেক কৃষিজমি উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিজমির ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে আমাদের সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত নীতিমালা গ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নই পারে কৃষিজমি সংরক্ষণ করতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিত গ্রাম নগরায়ন ও গৃহায়ন-প্রযুক্তি কৃষিজমি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। সেজন্য স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ের কাজ করতে হবে অন্যথায় কৃষিজমির ধ্বংস অনিবার্য। গত ৪ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেন, অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা, ফসলি জমি রক্ষা ও মজুতদারি রক্ষায় প্রত্যেক জেলা প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ছে এবং আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে সেহেতু অকৃষিজ কৃষিজমির নূ্যনতম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং উর্বর কৃষিজমি যেন অধিগ্রহণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এই খাতে সরকারের সুনজর একান্ত কাম্য। সর্বোপরি, আমাদের সচেতন সমাজকেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বঁাঁচবে কৃষিজমি, বঁাঁচবে কৃষক, বাঁচবে দেশ। ওমর ফারুক রাদি রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়