থুসিডাইসিস ফাঁদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন

থুসিডাইসিস ফাঁদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : দু'টি দেশের মধ্যে সংঘাত থাকবে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সংঘাত থাকবে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের আলাদা আলাদা বস্নক সৃষ্টি হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত রাষ্ট্রটি বেশি আক্রমণাত্মক হবে।

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০২৪, ০০:০০

আনোয়ারুল ইসলাম
যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দু'টি দেশের নাম কী? উত্তর হিসেবে অবশ্যই চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম আসবে। দেশ দু'টি বর্তমান পৃথিবীতে নিজেদেরকে সুপার পাওয়ার হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে বিশ্ব মোড়ল হিসেবে একক আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়। ফলশ্রম্নতিতে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে ব্রিটেন নিজের আসন হারিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরো বিশ্বে একমাত্রিক বিশ্বনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ২১ শতকের রাজনীতিতে বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেওয়ার মতো অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলো চীন। দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। ইতিমধ্যে দেশ দু'টি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। চীনের উত্থানকে ঠেকানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে- যা সরাসরি চীন বিরোধী। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হচ্ছে থুসিডাইডিসের ফাঁদ। প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসে এর উলেস্নখ পাওয়া যায় গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিস হতে। থুসিডাইডিসের ফাঁদ এই পরিভাষাটি গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের নামেই নামকরণ করা হয়েছে। ২০১২ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্রাহাম টি এলিসন যখন গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডিসের ঐরংঃড়ৎু ড়ভ :যব চবষড়ঢ়ড়হহবংরধহ ডধৎ গ্রন্থের উদ্ধৃত করে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠিত মহাপরাক্রমশালী শক্তিই চায় না যে অন্য কোনো নতুন উদীয়মানশক্তি তার কর্তৃত্বের জন্যে হুমকি হয়ে উঠুক। এলিসন ঐতিহাসিক এ রকম ১৬টি ঘটনা নিয়ে একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, উদীয়মানশক্তি কোনো প্রতিষ্ঠিত মহাপরাক্রমশালী শক্তির জন্যে হুমকি হয় এ রকম ১৬টি অবস্থার মধ্যে ১২টি অবস্থার শেষ পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি উদীয়মান এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্ব নেতৃত্বের আসন নিয়ে যে লড়াই হয় সেটিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকগণ থুসিডাইসিস ফাঁদ বলে উলেস্নখ করেন। ইতিহাসে থুসিডাইডিস ফাঁদের মূল কথা হলো, যখন একটি উদীয়মান শক্তি একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে, তখন সংঘাত, যুদ্ধের হুমকি বা বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। যেমন : আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উদীয়মান দেশ হলো চীন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত এ ধারণাটি আপেক্ষিক। থুসিডাইসিস ফাঁদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : দু'টি দেশের মধ্যে সংঘাত থাকবে। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সংঘাত থাকবে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের আলাদা আলাদা বস্নক সৃষ্টি হবে। ক্ষয়প্রাপ্ত রাষ্ট্রটি বেশি আক্রমণাত্মক হবে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিগত শতাব্দী থেকে বেশ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ। সেসময় আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে ছিল অস্থিতিশীল সম্পর্ক। চীনের প্রতি জাপানের আক্রমণাত্মক অবস্থায় আমেরিকা চীনকে কাছে টানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যখন জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করে চীন তখন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৬ থেকে ৭৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপস্নবের পর চীনে যখন কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তারা অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চীনকে ব্যবহার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেমন :১৯৭১ সালে পিংপং ডিপেস্নামেসির মাধ্যমে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ হয়। আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক খুবই বন্ধুসুলভ ছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর কতিপয় কারণ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বদলে গিয়েছে। চীন এখন অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতিতেও নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, যা আমেরিকার বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং কর্তৃক গৃহীত 'মেড ইন চায়না ২০২৫' শীর্ষক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে চীন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক নেতৃত্বের অন্যতম বাধা। \হচীনের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রভাব রুখতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো চীনের চারপাশে ঘেরা রাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী করা কিংবা সেগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আওতায় আনা। এই ঘেরাও নীতি স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও জাপানকে হটিয়ে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। চীনের এই উত্থান অর্থনীতিতে বিশ্ব শাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ এবং স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ অব্যাহত রাখার নীতি গ্রহণ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকলেও চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে প্রায় ৩০% বিনিয়োগ করেছে চীনে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি গ্রহণ করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের উত্থানকে দমিয়ে রাখতে চায়। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যবহার করছে। অনেকদিন থেকেই তারা চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাহিনী হিসেবে ভারতকে সহযোগিতা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নিজেরা সরাসরি যুদ্ধে জড়িত না হয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ দ্বারা শত্রম্নকে ঘায়েল করাটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। এ অঞ্চলের চীনের অন্যতম মিত্র পাকিস্তান এবং মিয়ানমার। বাংলাদেশ এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ 'সহাবস্থান নীতি' গ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ের সঙ্গে সমানভাবে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ২০১৩ সালে চালু হওয়া চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ'-এর (বিআরআই) অধীনে এই উদ্যোগগুলোকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। সেই বছরের শুরু থেকে চীন দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ পরিমাণে বিনিয়োগ করতে শুরু করে এবং ২০২২ সালের মধ্যে এই বিনিয়োগের অংক প্রায় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে। তারপর থেকে, বিশেষ করে ২০১৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনকে উদীয়মান শক্তি হিসেবে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র কতিপয় দেশ নিয়ে কিছু জোট গঠন করেছে। যার মধ্যে আইপিএফ, অকাস এবং কোয়াড অন্যতম। তাছাড়া চীনের 'বেল্ট এন্ড ইনিসিয়েটিভ রোড' প্রকল্প রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। আসিয়ান তথা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি রোধ করা ইত্যাদি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি অগ্রগণ্য দিক। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোকে সামরিক সহায়তাও প্রদান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সৌদি আরব। বর্তমানে এ অঞ্চলেও চীনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এবং ইরানের মধ্যকার চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে চীন। সৌদি আরবের চীনের সঙ্গে সখ্যতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করছে। ১৯৭৪ সালের ৮ই জুন সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ৫০ বছরব্যাপী 'পেট্রো ডলার চুক্তি' পুনরায় বহাল করেনি সৌদি আরব। এর মাধ্যমে সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের পেট্রোর ডলার চুক্তির অবসান হয়। সৌদি আরব বর্তমানে চীনের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মতামত দিয়েছেন। চীনের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম কথিপয় দিক হলো বিশ্ব রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক, আধিপত্যের বিরোধিতা করা এবং বিশ্বশান্তি রক্ষা করা ইত্যাদি। বর্তমানে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব থুসিডাইসিস ফাঁদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রাচীন যুগে যেভাবে এথেন্স এবং স্পার্টার মধ্যকার যুদ্ধ বর্তমানে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতীয়মান হয়। উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সংঘাত বিদ্যমান। যদিও দেশ দু'টির মধ্যে সরাসরি যুদ্ধ এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। চীন অধিকাংশ সময় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না। তাদের মধ্যকার বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধ ভবিষ্যতে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে থুসিডাইসিস ফাঁদের প্রয়োগ ঘটায় কিনা তা দেখার বিষয়। আনোয়ারুল ইসলাম : কলাম লেখক