কেমন চলছে মোদির নতুন সরকার

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মোদির সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ এবার তার দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় নতুন সরকার মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে মিত্ররা অখুশি হলে ভেঙে যেতে পারে জোট সরকার। এজন্য নিজের মতো করে সরকার চালাতে পারবেন না নরেন্দ্র মোদি। এর ওপর আছে এবার শক্তিধর ইন্ডিয়া জোট। তারাও সরকারকে এবার ছেড়ে কথা বলবে না। ফলে নতুন সরকারকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০০

আহমদ মতিউর রহমান
ভারতের নির্বাচনে জোটগত বিজয় অর্জনের পর এনডিএ নেতা নরেন্দ্র মোদি আবার ক্ষমতায় বসেছেন। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেছিলেন ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয়ের যত সম্ভাবনার কথা জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল তা হবে না। বরং ভরাডুরির শঙ্কা ছিল। মোদি ঝড় বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই এটা বলা হচ্ছিল। শেষে অনেকটা সে রকমই ঘটেছে। এবার চারশ আসন পার হবেন বলা হলেও আগের বারের ৩০৩ই হয়নি। থেমেছে ২৪০-এ, যা বিজেপিকে এককভাবে সরকার গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। দুই বড় শরিক অন্ধ্রপ্রদেশের টিডিপি ও বিহারের জেডিইউকে সঙ্গে নিয়ে শপথ নিয়েছেন মোদি। দপ্তরও বণ্টন হয়েছে। নতুন ৯ মুখসহ ৭২ জন মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভায় ৩০ জন মন্ত্রী, ৩৬ জন প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নীতীন গড়কারি, রাজনাথ সিং, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডা, শিবরাজ সিং চৌহান, নির্মলা সীতারমণ, এস জয়শঙ্কর, মনোহর লাল খাত্তার, এইচ ডি কুমারাস্বামী, পীযূষ গয়াল, ধর্মেন্দ্র প্রধান, জিতন রাম মাঞ্জি, সর্বানন্দ সোনোয়াল। এরা সবাই বিজেপির পুরনো খেলোয়াড়। জোট শরিকদের মধ্যে প্রথমে শপথ জনতা দলের (সেকুলার) এইচডি কুমারস্বামী। পরে জনতা দল (ইউনাইটেড) নেতা লালন সিং। উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম নেতা হিসেবে শপথ নিয়েছেন সর্বানন্দ সানোয়াল। পরে শপথ নেন কিরেন রিজিজু। মোদির মন্ত্রিসভায় আটবারের এমপি ও বিজেপির তফসিলি জাতিগোষ্ঠীর নেতা বীরেন্দ্র কুমার স্থান পেয়েছেন। মধ্যপ্রদেশের একটি সংরক্ষিত আসনে জয় পেয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। প্রশ্ন হচ্ছে এর পর কী? দল ও জোট পরিবর্তনে অভ্যস্ত দুই বড় শরিক তার সঙ্গে থাকবেন তো? এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। বিজেপি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তার আসন কমেছে ৬২টি। সবার মতামতকে উপেক্ষা করে চরমপন্থি নীতি অবলম্বন করে আসছিল তার দল। ভারতের জনগণ সেটা যে পছন্দ করেনি ভোটের ফলাফলে তা স্পষ্ট। মোদির বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ২৯৩ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছে কিন্তু বিশ্লেষকরা তৃতীয় মেয়াদে বিজেপির এই সরকার কতখানি টেকসই হবে আর কতখানি মি. মোদির বা কতখানি শরিকদের হবে সেটা নিয়ে ভাবছেন। এককভাবে সরকার গঠনের কোনো অবস্থায় নেই বিজেপি। বলা হতে পারে এনডিএর জোট সঙ্গীরা তো আছে অসুবিধা কি? উত্তর হচ্ছে প্রধান দুই জোট সঙ্গী চন্দ্র বাবু নাইডু ও নীতিশ কুমার সরকার গঠনে বিজেপিকে সমর্থন দিলেও তাদের সব খাই মিটেছে এমনটা বলা যাচ্ছে না। ফলে সরকার গঠনে কোনো অসুবিধা দেখা না দিলেও সংকট অন্যখানে। দলগত অবস্থানটি দেখে নেওয়া যাক। ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৪০ আসনে জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯টি তার সঙ্গে দুই স্বতন্ত্র যোগ হয়ে এই সংখ্যা এখন ১০১। অন্য দলগুলোর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি (এসপি) ৩৭টি, তৃণমূল কংগ্রেস ২৯টি, ডিএমকে ২২টি, তেলেগু দেসম পার্টি (টিডিপি) ১৬টি, জনতা দল (জেডি-ইউ) ১২টি, শিবসেনা (উদ্ভব) ৯টি, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপিএসপি) ৮টি ও শিবসেনা (এসএইচএস) ৭টি। এ ছাড়া লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস) পাঁচটি আসন পেয়েছে। চারটি করে আসনে জয় পেয়েছে ওয়াইএসআরসিপি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিবাদী)-সিপিআই(এম)। ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (আইইউএমএল), আম আদমি পার্টি (আপ) ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা (জেএমএম) তিনটি করে আসন পেয়েছে। দুটি করে আসন পেয়েছে জনসেনা পার্টি (জেএনপি), কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) (লিবারেশন), সিপিআই (এমএল) (এল), জনতা দল-জেডি (এস), ভিসিকে, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই), রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) ও জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স (জেকেএন)। এ ছাড়া একটি করে আসনে জয় পেয়েছে ২২টি দল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ৭ জন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স এনডিএ জোটের মোট আসন ২৯৩টি। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) জোটের মোট আসন ২৩৩টি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে ৩০৩ আসনে জয় পেয়েছিল। সেবার বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ ৩৫২ আসনে জয় পায়। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকদের প্রধান অন্ধ্রপ্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি ১৬টি এবং বিহারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের জনতা দল-ইউনাইটেড (জেডি-ইউ) ১২টি আসনে জয় পেয়েছে। এই দুই দল ছাড়া আরও একাধিক এনডিএ শরিকের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বিজেপিকে। এদের মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্রের শিবসেনার সিন্ধে গোষ্ঠী, বিহারের লোক জনশক্তি পার্টি এবং উত্তরপ্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দল। কিন্তু সুযোগ বুঝে তারা যে কোপ মারবে না সেটা বলা যাচ্ছে না। কারণ তাদের অতীতের রেকর্ড খুব একটা সুবিধের নয়। মোদি জোটের বিরুদ্ধে যে ইন্ডিয়া জোট তৈরি হলো তার শুরুটা করে দিয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী মি. নীতিশ কুমার। কিন্তু তিনি নির্বাচনের আগে আগে তার নিজের শুরু করা জোট ইন্ডিয়া ছেড়ে যোগ দেন বিজেপির এনডিএ জোটে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আবার বলা যেতে পারে সবটা হয়ওনি। নীতিশ কুমার ইন্ডিয়া জোটে থাকলে খেলাটা অন্য রকম হতে পারত। আবার তিনি এনডিএ জোটে যাওয়ার পরও কিন্তু বৈতরণী পার হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। কথা হচ্ছে তিনি ঘন ঘন জোট পরিবর্তন করেন। ২৪ জুন লোকসভার অধিবেশন বসেছে। ২৬ জুন স্পিকার নির্বাচন হয়েছে। সবদিকে নজর ইন্ডিয়া জোট তথা কংগ্রেসেরও। তারা আপাতত বিরোধী আসনে বসেছে। তুলনামূলক দুর্বল সরকারকে তারা ছেড়ে কথা বলবে না তা স্পষ্ট। বলা হচ্ছে, তারা দেখতে চায় এভাবে কতদিন চলে। ভারতে দল বা জোট পরিবর্তন হরহামেশাই চলে। দাবি পূরণ না হলে শরিকরা বেঁকে বসতে পারেন। সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই আছে কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোট। ভোটের ফলে তারা খুশি এটা স্পষ্ট। কংগ্রেস এবার ফিরে পেয়েছে বিরোধী নেতা হওয়ার তকমা। যা বিগত দুটো লোকসভায় তাদের ছিল না। ভারতে বিরোধী দল হতে হলে অন্তত ৫৫টি আসন প্রয়োজন। গতবার কংগ্রেস ৫২ আসন পেয়েছিল। এবার প্রায় দ্বিগুণ ১০১ আসন হওয়ায় লোকসায় ভালো পারফরম্যান্সস করতে পারবে দলটি এটাই তারা আশা করে। দলে ইন্দিরা গান্ধীর নাতি রাহুল গান্ধীর গুরুত্ব বেড়েছে। কংগ্রেস তথা ইন্ডিয়া জোট মোদির হিন্দুত্ববাদী ভারতকে বাস্তবে না হোক কাগজে-কলমে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে রূপান্তরিত করতে চায়, জনগণ সেটা সমর্থন করেছে বলে তারা আপাতত খুশি। দেশটির মুসলিম, নিম্নবর্ণের হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সংখ্যালঘুরা যে আশায় ইন্ডিয়া জোটকে বেছে নিয়েছে সেটা তারা পালন করে কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মোদির সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ এবার তার দল বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। এ অবস্থায় নতুন সরকার মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে মিত্ররা অখুশি হলে ভেঙে যেতে পারে জোট সরকার। এজন্য নিজের মতো করে সরকার চালাতে পারবেন না নরেন্দ্র মোদি। এর ওপর আছে এবার শক্তিধর ইন্ডিয়া জোট। তারাও সরকারকে এবার ছেড়ে কথা বলবে না। ফলে নতুন সরকারকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। \হতৃতীয়ত দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর মোদির দল ও জোট বিগত দিনগুলোয় যে অন্যায় করেছে জনগণ তার জবাব দেওয়ায় তা মি. মোদিকে আমলে নিতেই হবে। তাকে ধর্মনিরপেক্ষ একটা বাতাবরণ তৈরি করতে হবে। এটাও তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। মনে হচ্ছে, শরিকদের সহযোগিতায় বিজেপি জোট কোনোমতে সরকার গঠন করতে পারলেও আগামী দিনে তাদের পথচলা মোটেই মসৃণ হবে না, বরং শরিকদের আবদার ও দাবি-দাওয়া মেটাতেই বেশ তৎপর থাকতে হবে। সরকার পরিচালনায় তাদের পক্ষে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও সম্ভব হবে না। ফলে সরকারের ভিত্তি হবে খুবই ভঙ্গুর ও দুর্বল। একই সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটও নতুন সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। যা মোকাবিলা করার দুর্বলভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। লোকসভার প্রথম অধিবেশন পর্যন্ত পরিস্থিতি অবলোকন করেই কেবল পরের ধাপ পর্যন্ত বলা যাবে। এজন্য প্রয়োজন আরও কিছু সময়। আহমদ মতিউর রহমান : কলাম লেখক