দুর্নীতি শব্দটি যেন এ জাতির পিছু ছাড়ছে না
দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে সমাজে সততা ও নিষ্ঠার সৃষ্টি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
প্রকাশ | ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
হাসনাইন রিজেন
সালটা ১৯৭২ সাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজ চলছে। তখন বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য এনে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করছিল, এ সময় সাহায্য আসে ৮ কোটি কম্বল। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ছিল তখন ৭ কোটি। তারপরও নাকি কম্বলের ঘাটতি পড়ছিল- কারণ, এত কম্বল চুরি হয়ে যায়।
এক জনসভায় তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, 'সাত কোটি জনতার জন্য আট কোটি কম্বল এসেছে। আমার কম্বল কৈ? বঙ্গবন্ধুর এই আক্ষেপ থেকে বোঝা যায় স্বাধীনতার শুরু থেকেই বাঙালি জাতির সঙ্গে জড়িত আছে দুর্নীতি। ২০০৯ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে এসে প্রকাশিত গত বছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০তম। আপাতদৃষ্টিতে দুর্নীতি কমেছে বলে মনে হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির অবস্থান অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। উলেস্নখ্য, টিআই'র প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল। এর মধ্যে ২০০১ সাল ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ বছর। অপর দিকে, ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ছিল বিএনপির শাসনামল। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অর্থের যে অবাধ লুটপাট হয়ে আসছে তা সবারই জানার কথা। ২০১৯ সালে অবাধ লুটপাটের সামান্য হিসাব-নিকাশ তুলে ধরা হয় জাতীয় সংসদে। দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংসদে প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একই সঙ্গে, ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন- এমন ১৪ হাজার ৬১৭ জনের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও প্রকাশ করেছেন তিনি। সংসদে উপস্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে মন্ত্রী এ তালিকা দেন। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে এক লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জনের কাছে পাওনা এক লাখ দুই হাজার ৩১৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০১৮ সালে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়েছে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন এবং খেলাপি অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ২২০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এদের মধ্যে ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭০ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা। এদের কাছে খেলাপি ঋণ পাওনা ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। শ্রেণিকৃত ঋণ ৫২ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। শ্রেণিকৃত ঋণের অর্থ হচ্ছে দেয় অর্থের নতুন বিন্যাস। অর্থমন্ত্রীর দেয় তথ্য মোতাবেক, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে সাতটি ব্যাংক গত অর্থবছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে। সম্প্রতি বেনজীর আহমেদ এবং মতিউর রহমান দুর্নীতির কান্ডে আবার সমানে এসেছে বাংলাদেশে দুর্নীতির বিষয়টি। দেশের সম্পদ এক শ্রেণির কাছে কি পরিমাণ বাজেয়াপ্ত হয়ে আছে তা আবার সবার সামনে উঠে এসেছে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কালের কণ্ঠ। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত শিরোনাম ছিল 'বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ'। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট। এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তার পরিবার। এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাদের। ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের। এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়। একবার ভেবে দেখোন তো এই বেনজীর আহমেদের সারা জীবনের বৈধ উপার্জন দিয়ে তার বর্তমান সম্পদের পাঁচ ভাগের একভাগ সম্পদ তৈরি করা সম্ভব কিনা। প্রথম আলোর তথ্য মতে (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার স্বজনদের নামে থাকা এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারি দুইটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের হাতে কি পরিমাণ দেশের জনগণের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে তা বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ দেখলেই বুঝা যায়। আজকাল পত্রিকা হাতে নিলেই দেখা যায় কেউ বেগম পাড়ায় বাড়ি করেছে। কেউ লন্ডনে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। দেশ ও জনগণের সম্পদ যে যেভাবেই পারছে সে সেভাবেই লুট করে নিচ্ছে। অর্থনীতি সমিতির তথ্যমতে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। গত চার বছরে যা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরোটা টলারেন্স নিতে থাকলেও বাস্তবে তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সচেতন মহলে। দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, 'এখনো কিছুসংখ্যক লোক, এত রক্ত যাওয়ার পরেও যে সম্পদ আমি ভিক্ষা করে আনি, বাংলার গরিবকে দিয়ে পাঠাই, তার থেকে কিছু অংশ চুরি করে খায়। এদের জিহ্বা যে কত বড়, সে কথা কল্পনা করতে আমি শিহরিয়া উঠি। এই চোরের দল বাংলার মাটিতে খতম না হলে কিছুই করা যাবে না। আমি যা আনব এই চোরের দল খাইয়া শেষ করে দেবে। এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।' বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার পর সংগ্রামের পাশাপাশি এই দেশে ঘুষ ও দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামের ডাক দেন। যাতে আমাদের দেশে ঘুষ ও দুর্নীতি না করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ বয়স থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন তিনি। কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে ঘুষ-দুর্নীতি এই দুটো বিষয় দরকার। তাই শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, যদি কেউ আপনাদের নিকট অফিস-আদালতে কোনো ঘুষ চেয়ে থাকে তাহলে তিন পয়সার একটি কার্ড লিখে আমাকে জানাবেন। আমি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে সমাজে সততা ও নিষ্ঠার সৃষ্টি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করা জরুরি।
আমাদের দেশে আমরা নিজেরা যদি সচেতন না থাকি তাহলে দুর্নীতি কোনো দিন দূর হবে না।
হাসনাইন রিজেন : নবীন কলাম লেখক