শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

মাদকের আগ্রাসন রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

মাদকাসক্তি দূর করার জন্য সামাজিক ও পারিবারিক প্রচেষ্টাও খুব জরুরি। প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন; খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
আর কে চৌধুরী
  ২৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
মাদকের আগ্রাসন রুখতে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ

মাদক কেড়ে নেয় মানুষের মনুষ্যত্ব। মাদকাসক্তরা হারায় নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ। মাদকের জন্য এহেন অপরাধ নেই যাতে তারা পিছপা হয়। দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য মাদকাসক্তি ইতোমধ্যে হুমকি হয়ে উঠেছে। মাদক দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স সত্ত্বেও এর আগ্রাসন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ইরানসহ দুনিয়ার যেসব দেশে মাদক ব্যবসার শাস্তি মৃতু্যদন্ড সেসব দেশেও এর থাবা বন্ধ হয়নি এটি অতি লাভজনক ব্যবসা হওয়ার সুবাদে। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মেক্সিকোর মতো সমৃদ্ধশালী দেশের আইনশৃঙ্খলা বছরের পর বছর ধরে মাদক গডফাদারদের হাতে জিম্মি। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদিচ্ছা সত্ত্বেও ইয়াবা, কোকেন, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে এ দেশে আসছে বেপরোয়াভাবে।

মাদক কারবারিরা নৌ, সড়ক, রেল ও আকাশপথ ব্যবহার করে রাজধানীসহ সারদেশে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাচার ও বিক্রির ক্ষেত্রে তারা নিত্যনতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। অনলাইন পস্ন্যাটফরমকে টার্গেট করেও দেশে মাদকের ব্যবসা জমে উঠছে। বিজিবি গত বছর তাদের মাদকবিরোধী অভিযানে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৪ হাজার ৭৭৪ ইয়াবা, প্রায় ১৪৩ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, ১ লাখ ৮৫ হাজার ৮৩৩ বোতল ফেনসিডিল, ৩ লাখ ৪ হাজার ৭৪৯ বোতল বিদেশি মদ, ৯ হাজার ২৬৩ লিটার বাংলা মদ, ৫৭ হাজার ৮৯৯ ক্যান বিয়ার, ২২ হাজার ২২৯ কেজি গাঁজা, ৩৩১ কেজি হেরোইন, প্রায় ১৩ কেজি কোকেন, ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮৯ নেশাজাতীয় ও উত্তেজক ইনজেকশন, ১ লাখ ৫৩ হাজার ২১০টি অ্যানেগ্রা বা সেনেগ্রা ট্যাবলেট, ৬৫ হাজার ৬৬৪টি ইস্কাফ সিরাপসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও দৃশ্যত সদা তৎপর। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরাও স্বীকার করেন, উদ্ধারকৃত মাদকের পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি নয়। অভিজ্ঞজনদের ধারণা- এ হার সর্বাধিক ৫ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে- চোরাচালান ও মাদক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িতদের বড় অংশের মধ্যে সততার সংকট প্রবল। মাদক নিয়ন্ত্রণে সর্বাগ্রে সংশ্লিষ্টদের সততা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি।

দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা দ্রম্নত বাড়ছে। সব বয়সের মানুষই মাদকের দিকে ঝুঁকছে। এমনকি তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। একবার যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা আর তা থেকে মুক্ত হতে পারে না।

অন্যদিকে, মাদক সহজলভ্য হওয়ায় নতুন করে অনেকেই আসক্ত হচ্ছে। এখন মাদক এতটাই সহজলভ্য যে শুধু শহর নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই মাদকের প্রভাব কমানো যাচ্ছে না। বরং এর প্রভাব সামাজিক বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মাদকের উপকরণে বদল ঘটছে। বছর দুয়েক আগে ইয়াবাবিরোধী অভিযানের পর পত্রিকার খবরেই বলা হয়েছিল ইয়াবার চালান আরো বেড়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই তখন বলেছিলেন, মাদকবিরোধী অভিযানের অ্যাপ্রোচ ঠিক ছিল না। তার কারণেই সমস্যাগুলো হচ্ছে মাদক না কমে বরং পরিমাণে ও উপকরণে বাড়ছে।

মাদকের অপব্যবহার শুধু মাদকেই সীমিত থাকে না, আরো বহু অপরাধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, মাদকসেবীরা যেমন পরিবারের জন্য, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই ইয়াবা-আইসসহ সব ধরনের মাদক প্রতিরোধে সরকারকে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

তরুণ-যুবকদের বেশ বড় একটা অংশ এই আত্মঘাতী আসক্তির শিকার। তবে মাদকাসক্তি শুধু এই বয়সীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, পূর্ণবয়স্ক, এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তির এলাকাও সীমাবদ্ধ নেই- রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-মফস্বল পর্যন্ত সারাদেশে মাদকাসক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সঠিক পরিসংখ্যান মেলে না। বাংলাদেশে কতসংখ্যক মানুষ মাদকাসক্ত, এ বিষয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কিংবা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই। জানা যায়, সরকারের পরিসংখ্যান বু্যরোকে তারা এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য অনুরোধ করেছিল, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি।

পরিসংখ্যান না থাকা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়; এ থেকে বোঝা যায় সমস্যাটি সরকারের কাছে গুরুত্ব পায় কিনা। সংখ্যার হিসাব প্রকাশ পেলে সমস্যাটা যে কত ব্যাপক, তার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত এবং সমাজে এ বিষয়ে কিছু করার জোরালো তাগিদ সৃষ্টি হতো।

মাদকাসক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারহীনতার কারণে। দেশের অসংখ্য স্থানে প্রকাশ্যে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা চলে। নির্মূল করা দূরে থাক, নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ মাদকদ্রব্য আসে বিদেশ থেকে অবৈধ পথে। সীমান্তপথে মাদক চোরাচালান ও দেশের ভেতরে মাদকদ্রব্যের কেনাবেচা অত্যন্ত কঠোর হাতে বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে বিজিবি, পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জবাবদিহি নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। কারণ, তাদের একাংশের সহযোগিতা ছাড়া এই মাত্রায় মাদকের ব্যবসা চলা সম্ভব নয়।

মাদকাসক্তি দূর করার জন্য সামাজিক ও পারিবারিক প্রচেষ্টাও খুব জরুরি। প্রতিটি পরিবারের সন্তানদের দিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন; খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

মাদককে বলা হয় মরণনেশা। এই নেশায় যারা একবার আসক্ত হয়, তারা তিলে তিলে মৃতু্যর দিকে ধাবিত হয়। বিজ্ঞজনদের কোনো পরামর্শ-উপদেশ এই নেশা আসক্তদের সুপথে ফেরাতে পারে না। এভাবে সমাজে বেড়ে যায় মাদকসেবীর সংখ্যা। এই মাদক এখনো দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বিস্তার লাভ করছে। লাখো মানুষ আসক্ত হচ্ছে এই মরণনেশায়।

এর আগে হেরোইন নামে এক মাদক দ্রম্নত প্রভাব বিস্তার করেছিল মাদকসেবীদের মাঝে। এই নেশায় একবার আসক্ত হলে মাদকসেবীরা তিলে তিলে মৃতু্যর দিকে অগ্রসর হতো। অবশেষে এসব মাদককে অতিক্রম করে সর্বগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করে এক নম্বর স্থান দখল করে আছে সেই ইয়াবা। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করার পরও দেশে মাদকের ব্যবহার ও পাচার সন্তোষজনক মাত্রায় রোধ করা যায়নি। সরাসরি মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে অনেক মাদক কারবারি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। এত সব কঠোর সিদ্ধান্তের পরও থামানো যাচ্ছে না মাদকের কারবার। দেশে আইনি শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি থাকতে পারে না।

তারা যতই ক্ষমতাধর হোক আইনি শক্তির কাছে এক সময় তাদের মাথা নত করতে হবে। সরকারকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল করতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। মাদক ব্যবসায়ীরা যেমন পাচারের কৌশল পাল্টায়, তেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচক্ষণ কর্মকর্তাদেরও কৌশলী হতে হবে। তাহলেই তাদের পরাজিত করা সম্ভব। আমরা মনে করি, সরকারের নীতি-কৌশলের রূপান্তর ঘটিয়ে হলেও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই রক্ষা পাবে আগামী দিনের কর্ণধার দেশের যুব সমাজ। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান সফল হোক- এই প্রত্যাশা আমাদের।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে