জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) ২০২৫-২৭ মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ ১৮৯ ভোটের মধ্যে ১৮১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাকক্ষে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া এশিয়া-প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে সৌদি আরব, শ্রীলংকা ও উজবেকিস্তান এ নির্বাচনে জয়লাভ করে। ইকোসক জাতিসংঘের মূল ৬টি অঙ্গসংস্থার একটি এবং বহুপক্ষীয় ও উন্নয়ন কূটনীতি প্রশ্নে জাতিসংঘের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পস্ন্যাটফরম হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘের ৭৮তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি ডেনিস ফ্রান্সিসের সভাপতিত্বে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিজয় বার্তায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত বলেন, এ বিজয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও সৃষ্টিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়নের স্বীকৃতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মুহিত বলেন, ইকোসকের সদস্যপদ আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে অবাধ ও টেকসই উত্তরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইকোসকের সদস্যপদ জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরাম, কমিশন, কমিটি, নির্বাহী বোর্ড, ইউএনএসকাপ-এর মতো আঞ্চলিক পস্ন্যাটফরমসমূহে সহায়ক নীতি প্রণয়নসহ বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং জাতিসংঘের ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করবে। এ বিজয় আমাদের উন্নয়ন অভিজ্ঞতার সাফল্যসমূহকে বিশ্বের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে সহায়ক হবে।
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের বিজয়কে 'বাংলাদেশের উন্নয়ন সফলতার বৈশ্বিক স্বীকৃতির অংশ এ বিজয়' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একইদিন রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ আব্দুল মুহিত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটির (২য় কমিটি) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ইকোসোকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিন বছর মেয়াদে বাংলাদেশ দায়িত্ব পালন করবে। যে কোনো অর্জনই মানুষের জন্য গৌরবের ও সম্মানের। আর অর্জনের পরিধি ও পরিসীমা যদি দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে স্বীকৃতির আবহে তাহলে আনন্দের ফল্গুধারা প্রস্ফুটিত হয় বৃহৎ পরিসরে। বাংলাদেশকে নিয়ে একটি শ্রেণি সর্বত্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য এ বিশেষ শ্রেণিটিই আবার বিভিন্নভাবে জনগণের কাতারে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং কতিপয় জনগণও তাদের কোনো না কোনোভাবে সমর্থন প্রদান করে যাচ্ছে। যার কারণেই তাদের মধ্যকার শক্তি ও ভরসার জায়গা কিছুটা হলেও হালে পানি পাওয়ার মতো অবস্থায় নিভু নিভু করছে।
প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার অসংখ্য কারণ রয়েছে। সম্মানিত পাঠক আপনার নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশের বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ পস্ন্যাটফরমগুলোতে যোগ্যতর জায়গায় নেতৃত্ব প্রদান করছে। পৃথিবীর অনেক দেশের সমর্থনের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ সে সব জায়গায় পরিপক্ক আসন গড়তে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে এ জায়গাটিকে ধরে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত মন্ত্রে শপথের মাধ্যমে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করা। কেননা, কাজের মাধ্যমে কর্মদক্ষতায় অবস্থানকে পরিপক্ব করতে হয়। বাংলাদেশ সে পথেই হাঁটছে এবং সে কারণেই জলবায়ু সংক্রান্ত তহবিল সংগ্রহের কমিটিতে বাংলাদেশ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।
সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানসমূহে ম্যানেজার এবং লিডারের ভূমিকাকে তুলনীয় বিষয় হিসেবে ?উপস্থাপন করা হয়। স্বাভাবিকভাবে দেখা যায়, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তির ভূমিকা কেবল রুটিন রক্ষার ন্যায় হয়ে থাকে। এ সব ক্ষেত্রে পূর্বোক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপকের ন্যায় নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায়িত্ব পালন করেন। এ জায়গাতে সুদীর্ঘকাল পরেও ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যাদিতে কোনোরূপ পরিবর্তন আসেনি। এ কাজসমূহ কেবল একজন ব্যবস্থাপক করে থাকেন। কিন্তু একজন লিডার তিনিই যিনি একটি প্রতিষ্ঠানের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে থাকেন এবং সুনির্দিষ্ট মেয়াদকালে ইতিবাচক ও লক্ষণীয় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন। আন্তর্জাতিক ফোরামেও বাংলাদেশ মূলত লিডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে বাংলাদেশের জয় মূলত সার্বিক বিষয়ের প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হয়ে অনেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন- বিশেষ করে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় যারা বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ভরসার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সফল অগ্রযাত্রায় সরকার তথা সরকার প্রধানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের জনগণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সঠিক সময়ে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমন্বয়ের ধারাবাহিক সফলতার দৃশ্যমান প্রতিচ্ছবি জাতিসংঘের ইকোসকের পরিষদে বাংলাদেশের জয়। দেশের স্বার্থে যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে সরকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং জনগণ তাতে সমর্থন প্রদান করেছে এবং তৎপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন সম্ভব হয়েছে।
মনে রাখতে হবে বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে কেউ কারো জন্য জায়গা ছেড়ে দেয় না, যোগ্যতার কারিশমা দিয়ে জায়গা দখল করতে হয়। বাংলাদেশ যোগ্যতার কাঠামোতে একটি বিশেষত্ব দেখিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন। অর্থনৈতিক কাঠামোকে মজবুতকরণ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মুনশিয়ানা দেখিয়ে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের বিশেষ স্থান অর্জন একটি অভূতপূর্ব সাফল্য হিসেবে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনা শাসিত সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা এ সফলতার অন্যতম একটি মূলমন্ত্র হিসেবে রাজনৈতিক বোদ্ধারা মন্তব্য করেছেন। এমডিজি ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে আলাদাভাবে তার পরিচয়কে চিনিয়েছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণও রেখেছে বাংলাদেশ। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছে। নিজস্ব উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ মনোযোগ প্রদান করেছে, কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে। কাঠামোগত উন্নয়নেও বাংলাদেশের অগ্রসরতা দৃশ্যমান। বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত উন্নয়নে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ও নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের কার্যকর ভূমিকা অত্যন্ত অর্থবহ আকার ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের তৎপরতা উলেস্নখযোগ্য। কেবলমাত্র তা নয়, বিশ্বের যেখানে কোনো সংকট কিংবা অস্থিতিশীলতা দেখা দিলে বাংলাদেশ সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করবার চেষ্টা করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকার বিবৃতি প্রদান করেছে এবং সাধ্যমতো বিপদগ্রস্ত রাষ্ট্রটিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সার্বিক কারণেই বাংলাদেশের পথচলা অন্যদের কাছে প্রতিনিয়ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের যে অগ্রসরতা দৃশ্যমান সেটি চলমান থাকলে আগামীতে বাংলাদেশ বিশ্বে বিভিন্ন পস্ন্যাটফরমে নেতৃত্ব প্রদান করবে। বর্তমানে স্মার্ট বাংলাদেশের যে দৃশ্যপট সরকার উপস্থাপন করেছেন সেটির বাস্তবায়ন আগামীতে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে আরও মজবুত ও সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করবে।
আমরা মনে করি ও বিশ্বাস রাখি, বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে বাংলাদেশের জয়ে ব্যাপক খুশি হয়েছে। এও উলেস্নখ করতে হয়, এ অর্জনটিকে প্রকাশ্যে না আনার ক্ষেত্রে অনেকেই চেষ্টা করে থাকবেন। বলাবাহুল্য ওই পক্ষটিই সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে প্রচারিত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের বিশ্ব পরিমন্ডলে এমন দৃষ্টান্তমূলক অর্জন স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথে একটি অনিন্দ্যসুন্দর মাইলফলক হিসেবে মনে করি।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়