শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

চামড়া শিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা

চামড়াশিল্পকে টেকসই ও মানসম্মত উন্নয়ন করতে নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত নীতিমালা থাকা দরকার- যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
এম তাওকীর আহমদ
  ২৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
চামড়া শিল্পের সংকট ও সম্ভাবনা

চামড়াশিল্প এমন একটি শিল্প যা প্রাণীর চামড়াকে প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে। এটি মূলত প্রাণীর চামড়া সংগ্রহ, তা প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন পণ্য যেমন জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট এবং অন্যান্য চামড়াসামগ্রী তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই প্রক্রিয়াটিতে ট্যানিং নামে একটি প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা চামড়াকে দীর্ঘস্থায়ী এবং টেকসই করে তোলে। চামড়াশিল্প বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ- বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যেখানে এটি অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে। চামড়া শিল্পের শুরু হয় চলিস্নশের দশকে। ১৯৪০ সালে রণদা প্রসাদ সাহা একটি ট্যানারি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে ট্যানারি শিল্প স্থাপিত হয়। এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রেখে চলছে। চামড়া শিল্প দেশের অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। বর্তমানে দেশে ২২০টিরও বেশি ট্যানারি রয়েছে। এখানে প্রায় ২ লাখ শ্রমিক সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি শিল্প হওয়া সত্ত্বেও ২০১৭'র পর থেকে ক্রমান্বয়ে অবনতির সম্মুখীন হচ্ছে এই শিল্প। এই অবনতির কারণ পরিবেশদূষণ ও অনুন্নত কর্মপরিবেশ এই দেশীয় চামড়াশিল্পে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিগত এক দশকের ব্যবধানে চামড়ার জুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের চামড়াজাত পণ্যের দাম উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও বিস্ময়করভাবে কাঁচা চামড়ার দাম ক্রমাগত কমছে এবং তা প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত গরুর কাঁচা চামড়ার প্রতি বর্গফুট দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। কিন্তু ২০২৪ সালে তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরেও ৫০-৫৫ টাকা। কাঁচা চামড়ার জোগানের অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির মৌসুমে। একটা হিসাবে দেশে প্রতি বছর গড়ে বিভিন্ন পশুর ১ কোটি ৭০ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এই পরিমাণ কাঁচা চামড়া উৎপাদন করার পরও আমাদের দেশের সরকারের পর্যাপ্ত সহায়তার অভাব, চামড়া চোরাচালান ও দেশি-বিদেশি সিন্ডিকেট এই সম্ভাবনাময় রপ্তানিমুখী শিল্পের অন্যতম প্রধান বাধা।

ইপিবি (এক্সপোর্ট প্রোমোশন বু্যরো)-এর তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ১২৩ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার- যা বিগত বছরের তুলনায় ২১.৭০% কম। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় ৯৪ কোটি ১৭ লাখ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে আয় ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।

গণমাধ্যমের তথ্য মতে, মূলত চামড়া শিল্পকে বাধাগ্রস্ত করছে এলডবিস্নউজি সনদ। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডবিস্নউজি সনদ জরুরি। সেই সনদ আছে বাংলাদেশের মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের। ২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী মিলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রম্নপ বা এলডবিস্নউজি গঠন করে। সংস্থাটির লক্ষ্য হলো পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। এই সনদ চামড়াজাত পণ্যের ভালো দাম পেতে সহায়তা করে। এ ছাড়া পরিবেশ সুরক্ষায়ও ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূলে থাকায় মাঝখানে এ শিল্প বিকাশ একটু বাধাগ্রস্ত হলেও সে পরিবেশ ক্রমেই কাটিয়ে উঠছে। চামড়া শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। কিন্তু পোশাকশিল্পকে যতটা গুরুত্ব ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, চামড়া শিল্পকে ততটা দেওয়া হয় না। চামড়া শিল্পের চলমান সংকট রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ ও সুনজর দেওয়া জরুরি। চামড়া ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করা, অন্তত চামড়া মৌসুমে পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ ও কাজে লাগাতে পারে সে ব্যবস্থা করা সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিশ্চিত করা, চামড়া সংরক্ষণে পর্যাপ্ত লবণের জোগান নিশ্চিত করা এবং ভুর্তকি প্রদান করা, গ্রাম থেকে শুরু করে শহর পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহণ, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য পরিবেশবান্ধব কারখানা ও শিল্পনগরী গড়ে তোলা এবং কাঁচা চামড়া থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার নতুন নতুন বাজার তৈরির মাধ্যমে এ শিল্পকে নতুন মাত্রা দেওয়া সম্ভব। এই সম্ভাবনাময় শিল্পের প্রতি এখনই সুদৃষ্টি দেওয়া না হলে পাটশিল্পের মতো এ শিল্পকেও আমাদের হারাতে হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বর্তমানে রপ্তানি খাতে চামড়া শিল্পের অবদান ৯ শতাংশেরও বেশি। বিপুলসংখ্যক সম্ভাবনাও আছে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের।

\হচামড়াশিল্পকে টেকসই ও মানসম্মত উন্নয়ন করতে নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত নীতিমালা থাকা দরকার- যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এবং সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

\হ

এম তাওকীর আহমদ : নবীন কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে