ঈদুল আজহার আগমুহূর্তে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ঢাকাসহ চার মহানগর কমিটি, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলোপ, উপদেষ্টামন্ডলী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল, আন্তর্জাতিক কমিটি পুনর্গঠনের তথ্য দেশবাসীকে অবহিত করেছে। সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে স্থায়ী কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক স্তরেও এ ধরনের আরও পরিবর্তন দেখা যাবে। ঈদুল আজহার আগ মুহূর্তে অনেকটা আকস্মিকভাবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি বিলুপ্তি, উপদেষ্টামন্ডলী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এ দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে আকস্মিক বড় ধরনের পরিবর্তন/রদবদল/ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন বা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ ধরে নেওয়া যায়। বিএনপি ও বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন/রদবদল/ পুনর্বিন্যাস করা হবে- এমন গুঞ্জন সাত জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। বিএনপি গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে, কিন্তু আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি। রাজপথের আন্দোলনে ব্যর্থতা দলে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। জনশ্রম্নতি আছে, আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ বের করার তাগিদ বোধ করিয়েছে দলের হাইকমান্ডকে। তাগিদ থেকে বিএনপি হাইকমান্ড আন্দোলনে কেন সাফল্য আসেনি তা অনুসন্ধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল কয়েক মাস আগে। অনুসন্ধানে কিছু কারণ বেরিয়ে আসে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা কারণগুলো বিশ্লেষণের পর হাইকমান্ডের মনে হয়েছে আন্দোলনে সাফল্য না পাওয়ার জন্য দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, আন্দোলনে সমন্বয়হীনতা, আন্দোলনে গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল যেসব নেতাদের সেসব নেতাদের উলেস্নখযোগ্য সংখ্যকের নিষ্ক্রিয়তা মূলত দায়ী; এর সমাধান দরকার। ভবিষ্যতে আন্দোলনে সাফল্য পেতে হলে দলের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি, রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় থাকবেন এমন নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর আবশ্যকীয়তা উপলব্ধি করে বিএনপি হাইকমান্ড দল পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্তেরই প্রতিফলন কমিটি ভাঙ্গা-গড়া, কমিটিতে রদবদল। গত ১ মার্চ ছাত্রদলের নতুন কমিটি (আংশিক) গঠনের মধ্য দিয়ে বিএনপি হাইকমান্ড দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরুর বার্তা দিয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক দল শক্তিশালী, দলের কর্মকান্ড আরও গতিশীল করার প্রয়োজনে দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন/পরিবর্ধন/ সংযোজন/বিয়োজন/রদবদল/পুনর্বিন্যাস গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই করতে পারে। বিএনপি হাইকমান্ড দলের খোঁজখবর রাখে। এর ফলে দলের সমস্যা-সংকট, ঘাটতি হাইকমান্ডের ভালোভাবেই জানা থাকার কথা বা আছে। সে জানা থেকে হাইকমান্ড উপলব্ধি করতেই পারে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা, গুরুতপূর্ণ নেতাদের কারো কারো রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয়তার কারণে আন্দোলন-সংগ্রামে কামিয়াব হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, কামিয়াব হতে হলে দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকবে এমন নেতাদের দলের নেতৃত্বে আনার বিকল্প নেই। বিএনপি হাইকমান্ডের উপলব্ধি ঠিক না বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিএনপির বিগত দিনের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে আমজনতার ব্যাপক সমর্থন ও অংশগ্রহণ সত্ত্বেও আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে- এটা বাস্তবতা। গত বছরের মাঝামাঝি বিএনপির ঢাকার প্রবেশপথ অবরোধ কর্মসূচির সুপার ফ্লপ, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি আয়োজিত বিশাল জনসমাবেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মৃদু অ্যাকশনের শুরুতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ছত্রভঙ্গ হওয়া, বিশাল সমাবেশ চত্বর চোখের পলকে নেতাকর্মী শূন্য হয়ে পড়া, রাজপথে আন্দোলনরত কর্মী-সমর্থকদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কেউ কেউ কাপুরুষের মতো সটকে পড়ার ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। এতে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা, কতিপয় নেতার আন্দোলন-সংগ্রামে লোক দেখানো অংশগ্রহণ চাউর হয়েছে।
সাংগঠনিক দুর্বলতা, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের রাজপথের আন্দোলন থেকে পালানোর মনোবৃত্তি রাজনৈতিক দলের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম সফলের অন্তরায় তা বলা প্রয়োজন পড়ে না। বিএনপিকে রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে সাফল্য পেতে হলে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে, মাঠের আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন- এমন নেতাদের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের সিপাসালাহ করতে হবে, এটা বাধ্যবাধকতা বলা যায়। মহাবীর আলেকজান্ডারের একটা কথা আছে। তাহলো- 'আমি সিংহের বাহিনীকে ভয় পাই না যদি নেতৃত্বে ভেড়া থাকে, আমি ভেড়ার বাহিনীকে ভয় পাই যদি নেতৃত্বে সিংহ থাকে।' এ কথার মর্মার্থ সহজবোধ্য। বিগত দিনগুলোতে বিএনপির রাজপথের প্রতিটি কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমাগম হয়েছে। এতে বিএনপির আন্দোলন সফল হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অনেকেই। বাস্তবতায় দেখা গেছে, কর্মসূচিতে আমজনতার বিপুল অংশগ্রহণ সত্ত্বেও বিএনপির আন্দোলন ফেল করেছে। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটিকে 'ফর নাথিং কমিটি' বলা হলে অতু্যক্তি হবে না। এ কমিটির সাফল্য তো পরের কথা তৎপরতাও আশানুরূপ ছিল না। এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিভেদ, বিভাজন, কারো কারো কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতা চাউর হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি, সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তন/রদবদল/ সংযোজন/বিয়োজন আদতেই অপরিহার্য।
\হবিএনপি হাইকমান্ড দলের সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধি, দলের কর্মকান্ড আরও গতিশীল করার প্রত্যয় থেকে যদি দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন তাহলে হাইকমান্ডকে দূরদর্শী বলা যেতে পারে। তবে শুধু এ ক্ষেত্রে দূরদর্শী হওয়াই হাইকমান্ডের জন্য যথেষ্ট হবে না। দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়ও হাইকমান্ডকে দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রাখতে হবে লক্ষ্য হাসিল করতে হলে। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদের লোক, মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্ব বাছাইয়ে খুব সতর্ক হতে হবে হাইকমান্ডকে।
সমাজে ভালো ভাবমূর্তির অধিকারী- এমনদের বাছাই করে আনতে হবে দল সাজানোর জন্য।
তেলবাজ, তোয়াজকারী, ধান্দাবাজ, প্রচারমুখী, বিশ্বস্ততা নিয়ে দলে প্রশ্ন আছে এমনরা যেন কমিটিতে/দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান না পায়; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরা যদি নবগঠিত কমিটিতে বা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পায় বা কোনোভাবে ঢুকে পড়ে তাহলে তা হবে নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢুকানোর মতো।
বিএনপি টিকে থাকার লড়াইয়ে রত- একথা মনে রেখে দল সাজানোর কাজ করতে হবে বিএনপি হাইকমান্ডকে। বিএনপি যদি আন্দোলনে উপর্যুপরিভাবে ব্যর্থ হতেই থাকে তাহলে ভবিষ্যতে দল টেকানো সম্ভব নাও হতে পারে। বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজদের উজাড় করছে দলের জন্য। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে গেলে বিএনপি তাসের ঘরের মতো ধসে পড়া বিচিত্র নয়। বিএনপির মাঠের নেতাকর্মীরা রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে পাশে থাকবে এমন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামে কামিয়াব হওয়ার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা খুঁজতে হবে বিএনপি হাইকমান্ডকে। কমিটি ভাঙা-গড়া, কমিটিতে রদবদল, সংযোজন-বিয়োজন যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ ঢুকানোর মতো না হয় সেটাই বিএনপির নিবেদিত নেতাকর্মী, শুভানুথ্যায়ী, সমর্থকদের প্রত্যাশা। কেউ কেউ বলছেন, কাউকে কাউকে 'সাইজ' করার, কাউকে কাউকে 'লাইম লাইট'-এ আনার জন্য বিএনপিতে কমিটি ভাঙা-গড়া, কমিটিতে রদবদল/সংযোজন/বিয়োজন চলছে। এটা হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতা, আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার মাশুল দিচ্ছে- এটা উপলব্ধি করে হাইকমান্ড দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে নাকি কাউকে কাউকে 'সাইজ' করার, কাউকে কাউকে 'লাইম লাইট' আনার উদ্যোগ নিয়েছে সেটা এক সময় বুঝা যাবেই। বিএনপির কমিটি ভাঙা-গড়া, কমিটিতে রদবদল কতটা ফলদায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে।
জহির চৌধুরী : কলাম লেখক