স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপস্নব কর্মসূচি
বাংলাদেশ গত বছর ভালো রপ্তানি করেছে কৃষি খাতে। আমাদের যে হারে জনসংখ্যা ও ভূমি রয়েছে, তাতে আমাদের আরও অনেক বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা উচিত।
প্রকাশ | ২২ জুন ২০২৪, ০০:০০
হীরেন পন্ডিত
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপস্নব বাস্তবায়ন শীর্ষক এক আলোচনায় উলেস্নখ করা হয় বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের উদ্যোগে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপস্নব বাস্তবায়ন শীর্ষক আলোচনা সভায় আরও আলোচনায় ওঠে আসে বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন 'সবুজ বিপস্নবে'র। তার সেই সবুজ বিপস্নবের স্বপ্ন এখন কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। রাজনীতিবিদ, লেখক ও কলামিস্ট মোনায়েম সরকারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। কৃষিবিদ ডক্টর মোঃ হামিদুর রহমান এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশের কৃষকরা ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও দ্বিগুণ দৃঢ়তা ও শক্তি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশের বেশি কৃষিকাজে নিয়োজিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে তারা জমি ক্ষয়ের পরও কয়েকগুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের ১০ শতাংশ জমি উচ্চ ফলনশীল ফসলের আওতাধীন ছিল। এখন তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ১০ শতাংশ জমি সেচের আওতায় ছিল, এখন তা ৮০ শতাংশ। ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ ও ভুট্টা দশ গুণ।
বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, খোলা পানিতে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের প্রথম। হাঁস-মুরগি এবং দুগ্ধ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় খাদ্য সংকট সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হলেও মোট ফসল উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি টন। ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। ফসল উৎপাদন চার কোটি টনে পৌঁছেছে। ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সব বাধা অতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম ও ঘামের মাধ্যমে কৃষির প্রায় সব উপখাতে কৃষকের মন ও আত্মার জয়জয়কার। ৫৩ বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষ সমৃদ্ধির চাকাকে পেছন থেকে ঠেলে দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করেছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি করেছে অপ্রতিরোধ্য। লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের শীর্ষে উত্তোলন করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১ কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিক তাদের পরিশ্রমের প্রায় পুরো আয় দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে।
কৃষি গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য অনেক ভালো। বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার কৃষি বিজ্ঞানী এ দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপস্নবের উদ্যোগ না নিলে এবং কৃষি উৎপাদনের ভিত্তিমূল তৈরি না করলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আজকের এই অবস্থানে আসতে পারত না আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন শতাব্দীর মহানায়ক। এরপর তিনি দেশগঠনের অংশ হিসেবে যে সবুজ বিপস্নবের ডাক দিয়েছিলেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জমির মলিকানার সীমা নির্ধারণ করে সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। আমাদের কৃষি জমি যেভাবে কমছে, সেক্ষেত্রে তার সবুজ বিপস্নবনীতি এখনো প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সময়ের হিসেবে এই সামান্য কয়েকটি বছরে বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ কর্মতৎপরতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তার অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রতিভা এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার পরিস্ফুটন আমরা দেখতে পাই।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ডাক দিয়েছিলেন 'সবুজ বিপস্নব'-এর। তার সেই সবুজ বিপস্নবের স্বপ্ন এখন কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। কৃষি গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য তারই অনুপ্রেরণার ফসল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, পথভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তার এই অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হলেও বাংলাদেশ গত দেড় যুগে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি তার পিতার অসমাপ্ত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। আজ তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বদরবারে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভবিষ্যতে তারই হাতে পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন সফল হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের পর সুখী সমৃদ্ধ ও উন্নত 'স্মার্ট বাংলাদেশ' পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি অন্তপ্রাণ ও কৃষিবান্ধব।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। এসব প্রযুক্তিগত সুফল সম্প্রতি কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইন পরিষেবা বাড়ছে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা 'কৃষি বাতায়ন' এবং 'কৃষক বন্ধু কল সেন্টার' চালু করেছে। বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক সেবাগুলোর জন্য কল সেন্টার হিসেবে কাজ করছে 'কৃষক বন্ধু' (৩৩৩১ কল সেন্টার)। 'কৃষি বাতায়ন' প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে কৃষকরা এখন তাদের চাষের ফসল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারছেন, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নিতে পারছেন পরামর্শ। সরকারের বিভিন্ন কৃষি-সম্পর্কিত সেবাও পেয়ে থাকেন এই অ্যাপস ব্যবহার করে। তাছাড়াও রয়েছে ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষি বায়োস্কোপ। ফলে কৃষকরা সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। 'কৃষকের জানালা' নামে একটি উদ্ভাবনী অ্যাপসের সহযোগিতায় ফসলের ছবি দেখেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাগণ তাৎক্ষণিকভাবে শস্যের রোগবালাই শনাক্ত করতে পারেন।
এসবের প্রভাবে কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। ফলে ডিজিটাল কৃষির বাস্তবায়নে ও চতুর্থ শিল্পবিপস্নবের লক্ষ্য পূরণে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ও ক্লাউড বেইজড অটোমেটেড এগ্রিকালচারাল সিস্টেম।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রম্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) গবেষণাগারে প্রয়োগ করে 'স্মার্ট বাংলাদেশ' গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষির বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় আইওটি ব্যবহার করে এগ্রিকালচারাল গ্রোথ মনিটরিং সম্পর্কিত নতুন উদ্ভাবন কৃষি খাতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করা জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়গুলো অনেক সহজ করে দেবে। এই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি উন্নত কৃষি পরিচর্যার পাশাপাশি অধিক উৎপাদনশীলতা বিষয়ক তথ্য প্রদান করতে সক্ষম হবে।
স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনায় মাটির তথ্য যেমন- মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, পিএইচ লেভেল, মাটির ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি, মাটির মাইক্রো ও ম্যাক্রো পুষ্টিমান (যেমন : নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সালফার ইত্যাদি) পরিমাপ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সেন্সরের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির তথ্য সংগ্রহ করে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, উপযুক্ত পুষ্টি প্রদান করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা সম্ভব হবে। আইওটি সেন্সর এবং স্মার্ট সেন্সরবেইজড ক্যামেরা ব্যবহার করে মাটি সম্পর্কিত তথ্য ও স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ব্যবহার করে কৃষকরা সঠিক সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী পানির প্রবাহ বা সেচ ব্যবস্থাপনা প্রথাগত ম্যানুয়াল সিস্টেম থেকে অটোমেটেড সিস্টেমে রূপান্তরিত করতে পারবে। এসব ব্যবস্থায় কৃষকরা খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সিদ্ধান্ত দ্রম্নত নিতে পারবে ও খামারের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে বহুগুণে।
বঙ্গবন্ধু তার শাসনামলে এ দেশের কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে ২২ লাখ কৃষকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ১৯৭২ সালে কৃষকদের মাঝে ধান, গম ও পাটবীজ বিতরণ, বৃক্ষরোপণ অভিযান চালুকরণ, কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ, সার, কীটনাশক ও সেচযন্ত্র সরবরাহ এবং গ্রামভিত্তিক সবুজ বিপস্নবের কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি।
জাতির পিতা অনুভব করেছিলেন কৃষি গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তির প্রসার ছাড়া কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই মহান স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই কৃষির উৎপাদনশীলতা, গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে গতিশীলতা আনয়নের জন্য কৃষি ও কৃষির বিভিন্ন উপখাত সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পুনর্গঠন করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পুনর্গঠন করেন হর্টিকালচার বোর্ড। প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয় এবং ১৯৭৪ সালে অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে কৃষি গবেষণার উন্নয়ন ও সমন্বিত কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করা হয় এবং পুনর্গঠন করা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণা সমন্বয়, গবেষণা পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। পুনর্গঠন করা হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।
বাংলাদেশ আজ কৃষি উন্নয়নে বিশ্বপরিমন্ডলে এক রোল মডেল। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, অব্যাহত প্রণোদনা বাংলাদেশের কৃষি খাতকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি। কৃষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনের নিরিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, গবেষণাগার তৈরি, গবেষণার কাজে বর্ধিত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন। নতুন নতুন জাত, কলাকৌশল মাঠে ছড়িয়ে দিতে কৃষি বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ, উন্নত জাতের ফসল উৎপাদন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন, উন্নত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের জীবননির্বাহ কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকান্ড যেমন উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সহজ শর্তে কৃষি ঋণ বিতরণ ইত্যাদির জন্য দেশের শস্য নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী দিনের জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক চ্যালে মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি হতে হবে আরও টেকসই। এ জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য ও বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনী জনকে একযোগে কাজে লাগানো যেতে পারে। বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে কম আবাদযোগ্য জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভাসমান পদ্ধতিতে চাষের মতো কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সম্বলিত ড্রোন ব্যবহার করার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কৃষি জমির আগাম সার্বিক অবস্থা যেমন ফসলের মাঠের আর্দ্রতা, ফসলে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি নির্ধারণ, শস্য চারা রোপণ ডিজাইন করা, বীজ রোপণ করা, পোকার আক্রমণ জানা, কীটনাশক স্প্রে করা, ফসলের উৎপাদন জানা, ফসলের সার্বিক মনিটরিং করা, মাটির পুষ্টি, তাপমাত্রা, পিএইচ, লবণাক্ততা জানা, ফসলের রোগ ও পোকামাকড়ের উপস্থিতি জানা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং আগাম এলার্মিং, ফসলের আগাম সম্ভাব্য ফলনের পূর্বাভাস দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪ এ কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারের জন্য অন্যতম জাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২১-২০২৫-এ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে গবেষণা ও বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বস্নকচেইন কিংবা ট্রেসেবিলিটির ব্যবহার রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করার মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভিতকে করবে আরও মজবুত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রণীত ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট কৃষি লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। স্মার্ট কৃষি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান। অধিকন্তু স্বল্প সম্পদ বিনিয়োগে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে সর্বাধিক উৎপাদন করা। অল্প পানি, অল্প সার, অল্প কীটনাশক দিয়ে যদি বেশি পরিমাণ ফসল ফলানো যায় তাহলে কৃষিতে খরচ কমবে এবং উৎপাদন বাড়বে। এতে সময়ের পরিবর্তনে বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ দেশের জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশও গত ৫৩ বছরে ফসিল শক্তিনির্ভর কৃষি অনুসরণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষিজমিতে ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ১৭টি খাদ্য উপাদান। এর মধ্যে তিনটি উপাদানসমৃদ্ধ ফসিল শক্তিনির্ভর কৃত্রিম রাসায়নিক সার তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে বা যেসব দেশে ফসিল শক্তি দিয়ে সার উৎপাদন হয়, সেখান থেকে উচ্চমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করা হচ্ছে। আবার যেহেতু এসব রাসায়নিক সারের উৎপাদন খরচ বেশি, পুঁজিবিহীন গরিব কৃষকদের পক্ষে উচ্চমূল্যে তা কিনে জমিতে প্রয়োগ সম্ভব নয়, সেজন্য জনগণের করের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের জন্য সার কেনা সহজ করা হয়েছে। কৃষকরাও তা ইচ্ছামতো জমিতে প্রয়োগ করে চলেছেন। কারণ প্রশিক্ষণ দিয়ে ও প্রদর্শনী স্থাপন করে শেখানো হচ্ছে, জমিতে যত বেশি রাসায়নিক সার দেওয়া হবে তত বেশি ফলন।
দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান দানাদার ফসল বিশেষ করে ধানের শত শত আধুনিক জাত আবিষ্কার করে যাচ্ছে এবং এগুলো মাঠে নেওয়ার সহজ উপায়ও সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতগুলো এমনভাবে প্রজনন করা হয়েছে, যাতে জমিতে যত বেশি সার বা কৃত্রিম উপকরণ প্রয়োগ করা হবে তত বেশি ফলন পাওয়া যাবে। এতে অন্য দানাদার খাদ্যে সরবরাহ করে এমন প্রজাত আর চাষই হচ্ছে না। আবার ধানের মাত্র কয়েকটি জাত চাষ হচ্ছে। ফলে দেশ একক ফসল চাষের চূড়ান্ত ধাপে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সহজ পন্থা আবিষ্কার করেছেন, এতে শীত মৌসুমে সেচনির্ভর ধান চাষ বেশি হচ্ছে। সবুজ বিপস্নব বাস্তবায়নে শক্তি আশ্রয়ী রাসায়নিক সার ও পানিকে সহজলভ্য করা হয়েছে। কারণ নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো উৎপাদনে আগের সনাতন জাতগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বেশি পরিমাণে খাদ্য উপাদান ও পানির প্রয়োজন হয়, আবার মুষ্টিমেয় কয়েকটি জাত জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
আমাদের কৃষি শুধু ফসলনির্ভর নয়। কৃষিতে স্থায়িত্বশীলতা আনতে প্রাণিসম্পদ, মৎস্যসম্পদকে একত্রে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা পস্ন্যান প্রণয়ন করা হয়েছে, সে আলোকে এখনই একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তার সঙ্গে একটি কম্প্রিহেন্সিভ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের এখনই সময়। যুদ্ধোত্তর দেশে বাজেটের ১৩ ভাগ রাখা হয়েছিল এখন তা নেমে শতকরা ৩ ভাগের মতো। ফলে কৃষির উৎকর্ষের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বর্ধিত বিনিয়োগ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার হবে। সরকারের কৃষিনীতির অন্যতম লক্ষ্য কৃষি বাস্তুসংস্থানকে রক্ষা করা। মাটির ওপর ও নিচের জীববৈচিত্র্য বাড়ানো।
বাংলাদেশের কৃষিকে আলাদা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখেই আমাদের চলতে হবে। আগামীর কৃষি যে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির কৃষি সে কথা মাথায় রেখেই সরকার কাজ করছে। আমাদের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বড় সাফল্যটি হিসাব করা হয় জমি কর্ষণে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা পথ হাঁটলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কিংবা স্মার্ট কৃষির পথে আমাদের কোনোরকম অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশে কৃষি বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে রয়েছে মাঠ ফসল, সবজি, ফলমূল, ডেইরি, মাংস, মৎস্য ও পোলট্রি। এগুলো নিয়েই আমাদের কৃষি। আমাদের দেশের কৃষিতে প্রচুর মানুষ জড়িত। আগে কৃষিকাজ হতো শুধু উৎপাদনের তাগিদে। তবে ইদানীং উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াকরণসহ বিভিন্নভাবে মূল্য সংযোজন করে উন্নয়নের কাজও হচ্ছে। এখন আমাদের দেশে তরুণরা কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। অর্থাৎ বলা যায় আমরা কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিক কৃষির দিকে এগোচ্ছি। আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। যারা গ্রামে বাস করে, তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। আবার করোনার কারণে অনেক তরুণ চাকরি হারিয়েছে। অনেকে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে। তারা কৃষিতে যুক্ত হয়েছে। তারাও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে যান্ত্রিকীকরণ আরো বাড়বে।
আমাদের দেশে কৃষিতে ফুড ভ্যালু চেইনের সম্পূরক ভ্যালু চেইন নেই, যার কারণে এ অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে। ৫৩ বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি খাত শুধু উৎপাদনে জোর দিয়েছে। এতে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদনের পর যে প্রক্রিয়াকরণ করা প্রয়োজন, সে সক্ষমতা আমাদের দেশে নেই। প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা সেভাবে তৈরি হয়নি। ফলে কখনো দাম বেড়ে যায় আবার কখনো তা কমে যায়। ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠা করা গেলে কৃষকও ভালো দাম পাবেন এবং ভোক্তাও পণ্য কিনে সন্তুষ্ট থাকবেন।
বাংলাদেশ গত বছর ভালো রপ্তানি করেছে কৃষি খাতে। আমাদের যে হারে জনসংখ্যা ও ভূমি রয়েছে, তাতে আমাদের আরও অনেক বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা উচিত।
সমস্যা হচ্ছে আমরা এখন যা রপ্তানি করছি, তা মূলত যেসব স্থানে বাঙালি রয়েছে সেখানে। এটিকে মূলধারার বাজারে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমরা কৃষি থেকে ব্যাপক হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা খাদ্য সংকট নিয়ে পূর্বাভাস দিচ্ছে। সুতরাং আমাদের আরও মজুদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্য পরিবহণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াকরণে উন্নত হতে হবে। আমরা যা উৎপাদন করছি তা যদি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
হীরেন পন্ডিত :প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট