ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ

সর্বোপরি ঈদ যেন কারও ঘরে শোকের মাতম বয়ে না আনে। খুশির আমেজ বিদ্যমান থাকুক ঘরে ঘরে। নিরাপদ হোক প্রতিটি প্রাণ, দুর্ঘটনামুক্ত হোক সবার যাত্রা।

প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০

রিয়া বসাক
প্রতিনিয়ত সবকিছুর মূল্য বাড়লেও শুধু মূল্য বাড়ছে না মানুষের জীবনের। যার প্রমাণ পাই প্রতিদিন পত্রিকার পৃষ্ঠায় চোখ বুলাতে গেলেই। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ঝরছে প্রাণ এবং তুলনামূলকভাবে যা বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনার এসব খবরে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আর হৃদয়কে তাড়িত করে না। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারের কাছে সড়ক দুর্ঘটনা এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। কয়েক দিন পরেই মহাসমারোহে পালিত হবে ঈদ উৎসব। ঈদ মানেই আনন্দ, সে আনন্দ পরিবার প্রিয়জনদের সঙ্গে ভাগ না করলে থেকে যায় অপূর্ণতা। তাইতো নাড়ির টানে, প্রিয় মানুষকে দেখার আশায় সবাই ছুটে যায় নিজ কর্মস্থল ছেড়ে আপন শেকড়ে। অন্য সময়ের তুলনায় ঈদের সময়ে রাস্তাঘাট, রেলপথ, নৌপথসহ সব জায়গায় চোখে পড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। জীবনের তোয়াক্কা না করেই পথ পাড়ি দিতে হয় অনেককে। কারণ অপরদিকে অপেক্ষায় আছে হয়তো বৃদ্ধ বাবা-মা অথবা স্ত্রী সহ ছোট্ট ছেলে-মেয়েটি। বাড়িতে ফেরার জন্য যেমন খুশির আমেজ থাকে মনে, তেমনই মনের অজান্তে একটি শঙ্কাও মাথা চারা দিয়ে বলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারাব না তো? বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে মনে এমন শঙ্কা জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট আগের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো দুর্ঘটনা এবং হতাহতের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়ে গেছে অনেক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ বছরের মার্চ মাসে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত এবং ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন। এ বছরের এপ্রিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ৬৫৮টি দুর্ঘটনায় ৬৩২ জন নিহত ও ৮৬৮ জন আহত হয়েছেন। প্রতি বছর দুই ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি মানুষ একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। এসময় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি যানবাহনের চলাচল হয়। যার ফলে অনাকাঙ্‌িক্ষত ভাবে বহু দুর্ঘটনা ঘটে যায়। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিগত আট বছরে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মিলিয়ে তিন হাজার ৮৬২ দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৭৫ জনের মৃতু্য হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৬০ হাজার ৬৭৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। অর্থাৎ শুধু ঈদের মৌসুমেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৭.৩৫ শতাংশ মৃতু্য হয়েছে। তবে একটা স্বস্তির বিষয় হলো পদ্মা সেুু নির্মিত হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে ফেরিঘাট নামক দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই একটি সিদ্ধান্তে বহু মানুষের জীবন বদলে গেছে এক পলকে। ঈদে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হতো এই ফেরি পারাপারের সময়। সে ঝামেলা থেকে এখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ মুক্ত এটি একটি স্বস্তির বিষয়। কারণ এর আগে নদী পারাপারে অনেক দুর্ঘটনা হতো। বিগণ ৪৫ বছরে ২০২০ সাল পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৭০৩ জনের মৃতু্য হয়েছে। পদ্মা সেুু নির্মাণের আগে পর্যন্ত নৌ যোগাযোগই ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভরসা তাই নৌপথে চাপ ছিলো লক্ষণীয় এবং দুর্ঘটনা ও ঘটত প্রচুর। অন্য সময়ের তুলনায় ঈদের সময়েই দুর্ঘটনা বেড়ে যায় তবুও ঈদ পালন করতে চাওয়ার খুশিতে অনেকে হয়তো জীবনের মূল্য ভুলে যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চেপে বসে ট্রেনের ছাদে অথবা অধিক যাত্রীপূর্ণ লঞ্চে। ট্রেনের নিচে চাপা পড়লে বা লঞ্চডুবির কবলে পড়লে কি হবে তা ভাবার যেন ফুরসু থাকে না, যেকোনো মূল্যে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতনতা অবলম্বন এক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। বিগণ পাঁচ বছর আগে আমার পাশের গ্রামের এক পরিচিত বড় ভাই যে ছিল পরিবারের একমাত্র সন্তান, দিনে জীবিকার কাজ করে রাতে পড়াশোনা করে নিজের এবং পরিবারের দেখাশুনা করতো। গ্রামে ঈদের ছুটি কাটাতে আসার পথে দুর্ঘটনায় নিহত হন।তার পরিবারসহ পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। সেদিন তার পরিবারে ঈদ নেমে এসেছিলো বিষণ্নতার ছায়া হয়ে। এমন হাজারো ঘটনা প্রতিবছর ঘটে অনেক জায়গায় সেসবের খবর আমরা রাখি না। কিন্তু যে বা যার পরিবার হারায় কষ্ট টা শুধু তারাই বোঝে। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ মূলত পরিবহণগুলোর বেপরোয়া গতি। বিপজ্জনক ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, মাদক সেবন করে গাড়ি চালানো এবং যাত্রী ও পথচারীদের অসাবধানতা। বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায় চালক মাদকদ্রব্য সেবন করে অথবা ঘুমের চোখে গাড়ি চালায় যার ফলে রাতের পরিবহণগুলোই বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ঈদে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করার জন্য গাড়ির ফিটনেস ঠিক না থাকলেও নামানো হয় রাস্তায় যার ফলশ্রম্নতিতে দুর্ঘটনা আরও বেশি ঘটে। সড়ক পরিবহণ আইনের ৮৪ ধারায় অবৈধভাবে মোটরযানের আকৃতি পরিবর্তনে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, ৯৮ নম্বর ধারায় ওভারলোডিং বা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১০৫ নম্বর ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে? কিন্তু সংশোধনে ৮৪ ও ৯৮ ধারাকে জামিনযোগ্য অপরাধ, ৯৮ ধারাকে আপোষযোগ্য বলে প্রস্তাব করেছিল তারা। এমন আরও অনেক সংশোধন চেয়েছিলেন পরিবহণ শ্রমিকরা। যদি সড়ক পরিবহণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হতো তাহলে দুর্ঘটনার পরিমাণ এবং নিহতের সংখ্যা দুটোই কমে যেত। এসব দুর্ঘটনার দায় কি শুধু সরকারের? প্রত্যেকে যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন না হই তবে দুর্ঘটনা কখনোই কমানো সম্ভব নয়। যাত্রী এবং পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে যেন ঈদে ঝরে না যায় একটিও প্রাণ। ঈদে যেহেতু যাত্রীর চাপ বেশি তাই পরিবহণ সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সঙ্গে নিয়ম শৃঙ্খলার দিকে কড়া নজর দিতে হবে। সরকারের একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয় সবার সম্মিলিত সহযোগিণা ছাড়া। যাত্রীদের প্রত্যেককে মাথায় রাখতে হবে সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। একটি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঙ্গুরো পরিবার, অনেকগুলো মানুষের হাসি কান্না। এছাড়াও পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সবার উচিত গাড়ির ফিটনেস চেক করে গাড়ি নামানো এবং অন্যান্য সময়ের তুলনায় ঈদের সময়ে ট্রাফিক আইনে কড়া নিরাপত্তা দেওয়া, বেপরোয়া গতিতে যেন কোনো চালক গাড়ি না চালায়। ধীরগতির যানের জন্য সার্ভিস রোডে চলাচল নিশ্চিত করা। চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের দিকেও নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি ঈদ যেন কারও ঘরে শোকের মাতম বয়ে না আনে। খুশির আমেজ বিদ্যমান থাকুক ঘরে ঘরে। নিরাপদ হোক প্রতিটি প্রাণ, দুর্ঘটনামুক্ত হোক সবার যাত্রা। রিয়া বসাক : নবীন কলাম লেখক