বহুকাল ধরেই বাংলাদেশে বিসিএস ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক চলছে। অনেকেই বলছেন, এই পদ্ধতির কারণে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ফলস্বরূপ সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল থাকবে। এ সংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি ঘোষণা করে বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় দেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রযোজ্য হয়। বাকি ৪৪ শতাংশ থাকে সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের জন্য। ৫৬ শতাংশ কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, ৫ শতাংশ উপজাতি কোটা এবং ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা। তবে জবের পরীক্ষায় এই কোটা পদ্ধতি কতটুকু যৌক্তিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আরেকটি বিষয় হলো, আমরা শুধু বিসিএসে কোটা বিষয়ে বলছি। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এই কোটাব্যবস্থার দখলে অনেক যোগ্য প্রার্থী ঢুকতে পারছেন না। বর্তমানে জব পরীক্ষায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও পোষ্য কোটার দখলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রায় ৯০ শতাংশ পোষ্য কোটার দখলে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রেও পোষ্য কোটার দাপট লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানরা শুধু পাস নম্বর পেলেই ভর্তির সুযোগ পান। এ ক্ষেত্রেও কিছুটা লাগাম টানা প্রয়োজন। কেননা, বাবা-মায়ের চাকরির যোগ্যতায় কেউ বাড়তি সুযোগ পাবেন, সেটা কাম্য নয়। বর্তমানে বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ মাস জুলাইয়ে দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৬.৪৭ শতাংশ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে বেকার পুরুষের সংখ্যা ১৬ লাখ ৯০ হাজার, আর বেকার নারীর সংখ্যা ৯ লাখ ৪০ হাজার। কোটা পদ্ধতির কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বাড়ার প্রবণতা রয়েছে, ফলে তাদের পড়াশোনায় অনীহার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কোটা পদ্ধতি নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন। 'আমাদের সংবিধান বলছে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে সবার নিয়োগ লাভের সমান অধিকার থাকবে। অথচ এখন উচ্চতর সিভিল সার্ভিসের মেধার মাধ্যমে নিয়োগ পান ৪৪ শতাংশ প্রার্থী।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে, নারী কিংবা সমাজের অনগ্রসর শ্রেণি হিসেবে 'উপজাতিদের' জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় কোটা থাকতে পারে। সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের 'অনগ্রসর অংশের' জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে, 'অনগ্রসর অঞ্চলের' জন্য নয়। ফলে জেলা কোটার সাংবিধানিক ভিত্তি নেই বলা যায়। সংবিধান অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা কোটারও কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে তাদের সন্তানরা ঢালাওভাবে অনগ্রসর অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না। কোটার প্রয়োজন আছে, তবে সেটি যৌক্তিক বিবেচনায় হওয়া দরকার। প্রকৃত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী কিংবা অনগ্রসর এলাকার জন্য কোটা প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশের জন্য কোটার পরিমাণ অবশ্যই বিশাল যা অযৌক্তিক, সে বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি। আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যোগ্য এবং মেধাবী কর্মকর্তাদের প্রয়োজন। বিশেষ সুবিধায় কাউকে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান দিলে দেশের কতটুকু কাজে লাগবে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। একটা বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীদের সবাই যে মেধাবী হবে এমনটি আশা করা নিতান্তই বোকামি। কিন্তু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে সেখানে মেধাবীদের বিচরণ করার ক্ষমতা থাকে বেশি। কোটা ব্যবস্থা যদি দেশের সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে রাখতেই হয়, তবে সেটা সহনীয় মাত্রায় রাখা প্রয়োজন আর তা অবশ্যই ১০ শতাংশের বেশি নয়। সরকারি চাকরির বৃহদাংশ কোটার দখলে যাওয়ার পরও আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যা সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের হতাশা আর ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এদের মধ্যে রয়েছে- মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরির বয়সসীমা ৩২, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পাশাপাশি নাতি-নাতনিদের কোটার অন্তর্ভুক্ত করা এবং শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বিশেষ নিয়োগের ব্যবস্থা করা। একটি স্বাধীন দেশের জনগণ হিসেবে সবার সমঅধিকার পাওয়ার কথা, কিন্তু কোটা ব্যবস্থার কারণে সাধারণ জনগণের সমঅধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খুব কমসংখ্যক মানুষ চাকরির কয়েকগুণ বেশি সুবিধা পাচ্ছে। বিশেষ নিয়োগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি বঞ্চিত করা হয়। বর্তমান অবস্থায় কোটার পরিমাণ বহাল রাখার অর্থ হচ্ছে দেশের বৃহদাংশকে অবমূল্যায়ন করা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া। সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ক্ষেত্রে চাকরির বয়সসীমা ৩২, কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ৩০, এক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা। কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ দেওয়া যাবে না। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার করা যাবে না। আমাদের দেশ উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, চারদিকে উন্নয়নের নানা চিত্র পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বঞ্চিত রেখে সেই উন্নয়ন কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোটার অন্তর্ভুক্ত তরুণরা মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। শুধু তাদের সন্তুষ্টি, সমর্থন এবং মেধার প্রয়োগ দেশকে গতিশীল করতে পারে না। কোটা সংস্কারের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়নে সবার সুষম অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব আর তখনই দেশ টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত হবে বলে মনে করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
সাকিবুল হাছান :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট