বাজেট ভাবনায় শঙ্কিত যারা
মনে রাখতে হবে, জিডিপির সঙ্গে তাল রেখে সাধারণ মানুষের ইনকাম তেমন বাড়েনি। বরং বেশিরভাগ মানুষ উল্টো সারাবছর ঋণের ওপর থাকে।
প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
মোহাম্মদ আবু নোমান
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বয়স্ক অর্থমন্ত্রী হিসেবে গত ৬ জুন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করে রেকর্ড গড়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার আগে ৮১ বছর বয়সে এসে 'প্রথম বাজেট' কেউ পেশ করেননি। তিনি যখন বাজেট পেশ করেন তখন দেশের অর্থনীতি নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে। তবে নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কতটুকু সম্ভাবনা জাগাতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রিজার্ভের ঘাটতি, ডলারের উচ্চমূল্য, আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা, অর্থ পাচার ও লাগামহীন দুর্নীতিসহ নানা চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতিতে; অর্থাৎ একটি কঠিন বা বৈরী সময়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট দেওয়া হয়েছে। এ বাজেটে নানা সংকটের কথা বলা হলেও এসব থেকে উত্তরণে বাজেটে কৌশলগত ফিনিসিং বা কোনো ক্লিয়ারেন্স নেই। নেই আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো পদক্ষেপ। অর্থ পাচার রোধ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, অপচয় কমানো ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমরা দেখি না।
কোনো দেশের একটা গোষ্ঠী যদি বেশি আয় করে, আরেকটা গোষ্ঠী কম আয় করে, তখনই বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। রাজধানীর গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির যে অর্থনীতি, গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র সেটি নয়। অর্থনীতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতি থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, অর্থনীতির শক্তি কৃষক, শ্রমিকসহ গ্রামের মানুষ, শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই নয়। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়ার বছরব্যাপী অবশ্যম্ভাবী নিয়তি ও অভিন্ন দুর্ভোগের মাত্রা বাজেটের পর অসহনীয় হয় খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয় স্বল্প ও নিন্ম আয়ের মানুষ। অবস্থা এমন যে, গরিব ও সাধারণ মানুষ না খেয়ে মরে যাবে, বড়লোকরা সব কিনে নিয়ে যাবে! এটা তো কোনো সভ্য সমাজের কাজ হতে পারে না।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট কেমন হবে সে বিষয়েই চলছে জল্পনা-কল্পনা। সময়ের প্রেক্ষাপটে বাজেট একটি অর্থবছরকে ঘিরে আবর্তিত হলেও বাজেট অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একসঙ্গে ধারণ করে অতীতের মূল্যায়ন, বর্তমানের অবস্থান এবং ভবিষ্যতের ভাবনাকে তুলে ধরে। সে কারণে বাজেট বিশেষ গুরুত্ব পায় অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির পথপরিক্রমায়। জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাব যেন শুধু পাঠে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সম্পদ কোত্থেকে আসছে আর কোথায় কোন খাতে ব্যয় হবে ইত্যাদি নির্দেশনাও স্পষ্ট থাকা জরুরি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২ জুন তখনকার সময়ের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের দেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। এখন মানুষ বাড়ছে, অর্থনীতির আকার বাড়ছে। সেখানে বাজেটও বাড়ার সঙ্গে কর ও রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের দিকে জোর দিতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়, অতিরঞ্জিত বাজেট, গরিব মারার বাজেট এসব কথাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলে বাজেট বাস্তবায়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন মোটেই অসম্ভব নয়। বড় বাজেট যেন বড় ধরনের প্রতারণা ও বরাবরের মতো লোক দেখানো না হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়বে বলে বলা হয়েছে, বাজেট পাস হওয়ার আগেই ইতোমধ্যে তার দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু যেসব পণ্যের দাম কমবে বলে বাজেট প্রস্তাবনায় ঘোষিত হলো, সর্বশেষ বাজেট পাসও হলো। কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা গেল সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র। যেসব পণ্যের দাম কমবে বলে বাজেটে প্রস্তাবনা ছিল, বাস্তবে দেখা গেল তার দাম এক টাকাও কমেনি। ফলে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে বাজেট কোনো ভূমিকা রাখতে না পারায়, তারা বাজেট ভাবনায় বরাবরই শঙ্কিত, আনন্দিত নয়। বাজেট ঘোষণার পাশাপাশি বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় খোঁজা ও তদারকি নিশ্চিত করাটা খুবই জরুরি নয় কী? দুর্ভাগ্য এ জাতির, এ বিষয়টি কে দেখবে! কে শুনবে কার কথা? প্রতি বছর বাজেটকে কেন্দ্র করে এসব অস্বাভাবিক তৎপরতা নতুন কিছু কী? এই যে পরিকল্পনাহীনতার অভিযোগ, এই অভিযোগ কেন বছরের পর বছর ধরে চলবে? কেন এই অভিযোগ দূর করার জন্য কোনো উদ্যোগ সরকার নেবে না?
সার্বিক বিবেচনায় দরিদ্র ও নিন্ম আয়ের মানুষের জন্য বছরের মধ্যে বাজেট যেন নতুন করে উদ্বেগ, আতঙ্ক, ভীতি, হতাশা ও গলার কাঁটার সঙ্গে 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। বর্তমানে মাথাপিছু আয় যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে ব্যয় বেড়েছে তিন-চার গুণ। এতে সাধারণের ঋণগ্রস্ত হয়ে পারিবারিক বাজেট সামাল দিতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত আর গরিবরা নানা কষ্টে দিন যাপন করছে।
মনে রাখতে হবে, জিডিপির সঙ্গে তাল রেখে সাধারণ মানুষের ইনকাম তেমন বাড়েনি। বরং বেশিরভাগ মানুষ উল্টো সারাবছর ঋণের ওপর থাকে।
কর্পোরেট কোম্পানিগুলো বিশেষ মেকানিজম ব্যবহার করে বরাবরই কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। ব্যাংক খালি করে এ দেশে বিনিয়োগ না করে রাঘববোয়ালরা বিদেশে মুদ্রাপাচার করছেন, মোটের ওপর জিডিপির ভাগ কোটিপতিদের পেটে, আর সরকারেরও এই ব্যাপারে বিশেষ নজরদারি যথেষ্ট নয়। সরকারকে শুধু জিডিপি নিয়েই মহাখুশি থেকে বহুবিধ শুভঙ্করের ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে, দেশে সামগ্রিকভাবে সুশাসন আসা করা যায় না।
যারা কর ফাঁকি দেন, তাদের ওপর চাপ না বাড়িয়ে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপর বাড়তি কর আদায়ের ছক দেখা গেছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা, পুঁজি পাচার ও হুন্ডি বন্ধসহ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগের কথা বাজেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সাধারণ জনগণকে বড় ঋণখেলাপিদের জন্যও প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে। সরকারি খাতে যে দুর্নীতি হয় তা যদি রোধ করা যায় এবং রাজস্ব যদি যথার্থভাবে আদায় করা যায়, তাহলে বর্তমানে যে রাজস্ব আয় হয় তাই দিয়েই অনেক ভালোভাবে দেশ চলতে পারে। অযথা করের বোঝা বাড়িয়ে, বিদু্যৎ, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সাধারণ জনগণকে বিপদে ফেলার প্রয়োজন হয় না।
ইতোপূর্বে শিক্ষক ও সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে বাজার দরও বেড়েছে। এতে নিন্ম ও মধ্যবিত্ত জনগণ বেহাল অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দেশ যখন এগিয়ে চলেছে এবং উন্নয়নশীল দেশের পথে যাত্রা করেছে, তখন আমরা গণমুখী বাজেট প্রত্যাশা করি। টেকসই উন্নয়ন করতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে, কমিয়ে আনতে হবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। এজন্য বাজেট প্রণয়নে গরিবের কথা মাথায় রাখতে হবে। গরিবের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিসে যেন দাম না বাড়ানো হয়, এটা সর্বসাধারণের প্রত্যাশা। গরিব ও খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের জন্য সুবিচারমূলক বাজেট যেন হয়। গরিব মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সেদিকে আন্তরিক দৃষ্টি দিতে হবে। স্বাধীনতার পর দেশ অনেক এগিয়েছে ঠিক, কিন্তু তা অনেকটা ব্যক্তির উন্নয়ন। ব্যক্তির উন্নয়নের লাগাম টানতে পারলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে। এমন বাজেট আমরা চাই না- যা মধ্যবিত্ত ও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য অশান্তি ও দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ নিন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্ত। তাই বাজেটে নিত্যপণ্যের মূল্য গরিব ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা জরুরি। মোটা কাপড়, মোটা চাল, ডাল, আলু, আটা, লবণ, চিনি, পেঁয়াজ, সবজি, তেল প্রভৃতির দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকলেই সর্বসাধারণ সন্তুষ্ট। গরিব মানুষ যাতে কম ভিজিটে ডাক্তার দেখাতে পারে, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ যাতে কমমূল্যে কিনতে পারে, সে জন্য ওষুধপত্রের ওপর যেন ভ্যাট না রাখা চাই। করের ভারটা বেশিরভাগই নিন্মবিত্ত মানুষের ওপর পড়ে থাকে। কেননা, তারা আয়ের একটি বড় অংশ অতিপ্রয়োজনীয় ভোগের জন্য ব্যবহার করে। পণ্যের ওপর আরোপিত করের হার, গরিবের আয়ের আনুপাতিক হারের তুলনায় অনেক। সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবাটা আরও সহজ করতে হবে। আপামার জনগণ খেয়েপরে কোনোরকমে থাকতে চায়, তাই বাজেট হওয়া চাই দরিদ্রবান্ধব।
মানবসম্পদই আমাদের মূল সম্পদ। এ সম্পদের উন্নয়নে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বরাবরই বোঝা হিসেবে দেখা হয়ে আসছে। কিন্তু যথাযথ কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেলে এ বিশাল জনসংখ্যা আমরা জনসম্পদে পরিণত করতে পারি। এত সস্তা জনশক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে বাজেটে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ত। আমরা যে নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে বের হয়ে আসার আশা করছি, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রজাতন্ত্রের সাধারণ মানুষের প্রতি সুদৃষ্টি রেখে বাজেট করা হবে এটি সর্বসাধারণে প্রত্যাশা। সাধারণ মানুষই ক্ষমতার উৎস। তারা যেন মোটা ভাত, মোটা কাপড় থেকে বঞ্চিত না হয়। এসব মানুষ বাঁচার জন্য কঠিন সংগ্রামে ব্যস্ত। নিত্যনতুন গাড়ি আমদানির বাজেট নয়, স্বদেশভূমির দিকে চেয়ে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য কমানোর বাজেট হোক। সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের কাছে তার মৌলিক অধিকারগুলো চাওয়া এটা কোনো অপরাধ নয়।
মোহাম্মদ আবু নোমান :কলাম লেখক