প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, এমনকি মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটেছিল। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে শুভেচ্ছা জানানোসহ অন্যান্য রীতি অনুসরণ করেন। বিএনপির নেতাদের বিশ্বাস ছিল, ভারতের কংগ্রেস সরকারের সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে তৎকালীন সময়ে বিএনপি মনে করেছিল, কংগ্রেসের প্রধান সোনিয়া গান্ধী, দেশটির রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে- তাদের ধারণা, এ সম্পর্ক যতটা না রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, তার চেয়ে বেশি শেখ হাসিনার সঙ্গে কংগ্রেসের। এ সব কারণেই কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক রাষ্ট্রের তুলনায় ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক পর্যায়ে দৃঢ় ছিল বিশেষ করে যেটি মুক্তিযুদ্ধকালীন থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
বিএনপির নেতারা আরও মনে করতেন, শুধু শেখ হাসিনা নন, আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কংগ্রেসের অনেক নেতার ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা সম্পর্ক রয়েছে। সঙ্গতকারণেই বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কংগ্রেসের মতো এত নিবিড় হবে না। ফলে আগের মতো ভারতের একতরফা সমর্থন না পেলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা একটা মানসিক চাপে পড়তে পারেন যেটি দেশ পরিচালনা ও সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা ও রাজনৈতিক পারদর্শিতা থেকেই বিএনপির নেতারা মোদির বিজয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ ও মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। ক্ষমতার মসনদে মোদি দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপির নেতাদের ধারণা কিছুটা হলেও ভুল প্রমাণিত হয়।
বিজেপির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে রাজনীতিতে প্রচলিত ছিল, কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর সরকারের সঙ্গে তথা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মোদির একটি চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ২০১৪ সালে যখন বিজেপি ক্ষমতায় আসে তখন বিএনপি উচ্ছ্বাসও দেখিয়েছিল। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মোটাদাগে মোদির ৫ বছরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালোই ছিল বলে দেখা গেছে। এই সম্পর্ক একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সে কারণে ২০১৯ সালে মোদির বিজয়ের পর বিএনপির তেমন একটা উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়নি।
২০২৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে বিজেপির ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পরও বিএনপির নেতাদের প্রকাশ্য অভিনন্দন বার্তা এখনো আসেনি। পরিস্থিতি দেখে দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে মতামত প্রদানের ব্যাপারে হয়ত নেতারা অপেক্ষা করছেন। তবে বিজেপির বিজয়ে বিএনপির রাজনীতির খুব একটা পরিবর্তন হবে কিংবা রাজনীতিতে বিএনপি বিজেপির কল্যাণে ভারত থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত হবে এমনটি ভাবার কোনোরূপ সুযোগ নেই। ইতোপূর্বে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাদের যে উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছিল বর্তমানে কিন্তু তেমনটি আর নেই। বিএনপি নেতৃত্ব মনে করেছিল কংগ্রেস যেভাবে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সঙ্গে একটি সুসস্পর্কের ভিত রচনা করেছিল মোদি সরকার হয়ত সে জায়গা থেকে সরে এসে বাংলাদেশে নতুন পস্ন্যাটফরমের দিকে ঝুঁকতে পারে অর্থাৎ বিএনপির দিকে ঝুঁকতে পারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মোদি সরকারের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের ভিত আরও মজবুত অবস্থার দিকে ধাবিত হয়েছে। মোদির সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও মজবুত করার ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিদেশি দূতাবাসগুলোতে অতিমাত্রায় যোগাযোগ ও কূটনৈতিকদের ওপর অধিক নির্ভরতা মাঠের রাজনীতিতে বিএনপিকে কিছুটা হলেও দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কাছ থেকে দূরে রেখেছে। অতিমাত্রায় বিদেশ নির্ভরতার কারণে সাধারণ জনগণ থেকে ক্রমশ বিএনপি দূরে সরে গেছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পৃথিবীর শীর্ষ ৩৫টি রাষ্ট্রের একটি। তাছাড়া, আগামীতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অবস্থান ও রাজনীতিতে পৃথিবীর শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করবে। সে জায়গা থেকে বিএনপির বিদেশ নির্ভরতাকে দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ মেনে নিতে পারেনি। সঙ্গতকারণেই বিএনপির আহ্বানে আহূত দলীয় আন্দোলন ও সংগ্রাম ব্যাপকভাবে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা প্রদান করেছে, তারা বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে। প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্তের সমন্বয়ে প্রকৃতঅর্থে দোষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরা একটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু তার পূর্বে বিএনপির মনে রাখতে হবে বিএনপির সরকারের শাসনামলে দুর্নীতিতে পর পর পাঁচবার বিশ্বর্ যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, এটি একটি লজ্জাজনক উদাহরণ বাংলাদেশের জন্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে বিএনপির অবস্থান কি সে ব্যাপারটি জনসন্মুখে প্রকাশ করা অবশ্য কর্তব্য। অন্যথায় বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ জনসমর্থন পাওয়ার যোগ্যতা হারাবে। কেননা, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রণয়ন করেছে এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাদের ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত কাজ শুরু করেছে।
কাজেই বিএনপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান সেটির পরিবর্তনের জন্য বিদেশি কোনো শক্তি কিংবা বিদেশি সরকার প্রধানের কোনোভাবেই ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। বিএনপির উচিত হবে দলীয় সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হওয়া। কাউন্সিলের মাধ্যমে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচন করে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচন করার দিকে মনোনিবেশ করা। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার বাইরে, এ অবস্থায় বিএনপির সাংগঠনিক ঐক্য প্রয়োজন। এ জায়গাতে বিএনপি বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখনো পকেট থেকে কমিটি বের করে ঢাকা থেকে কমিটি গঠন করা হচ্ছে- যেখানে তৃণমূলের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়। আবার টাকার বিনিময়ে পদপদবি প্রদান করা হয়- এমন অভিযোগও দীর্ঘদিনের। ফলশ্রম্নতিতে দলের মধ্যে বিভাজন, অন্তঃকোন্দল ও অন্তদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সে কারণেই বিএনপি ঘোষিত আন্দোলন সংগ্রামে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অপরাগতা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ দলীয় হাইকমান্ড নেতাকর্মীদের জন্য যে বার্তা প্রেরণ করেছে সেটি তারা যথাযথভাবে পালন করেনি। ফলশ্রম্নতিতে বিএনপি ঘোষিত আন্দোলন জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আর দলের মধ্যে যেহেতু শৃঙ্খলিত কমান্ড ছিল না সেহেতু যারা সাধারণ সমর্থক কিংবা রাজনীতির বাইরের মানুষ তাদের বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচি তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। বিএনপির রাজনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গ ছাড়া জরুরি হয়ে পড়েছে। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জরুরি ভিত্তিতে কাউন্সিল আয়োজন করা উচিত।
কাউন্সিলরদের ভোটে নেতা নির্বাচনের সুস্পষ্ট বিধান দলীয় গঠনতন্ত্রে রয়েছে এবং সেভাবেই নেতা নির্বাচন করা দলটির অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশিদের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে হবে এবং দলের নির্দেশদাতা দেশে থেকেই দল পরিচালনা করতে পারে এমন নেতৃত্ব নির্বাচন করা দলের জন্যই উত্তম হবে। বিজেপি কিংবা চীনের কোনো রাজনৈতিক দল বিএনপির অবস্থানকে কখনোই পরিবর্তন করতে পারবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত দলটি নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের জন্য ব্রতী না হবে। বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দলটির রাজনীতি পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্য কোনো উপায়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা দলটির জন্য সহায়ক হিসেবে ধরা দেবে না এবং এসব ইতোমধ্যে প্রমাণিত। কাজেই সব ধরনের বহিঃশক্তির সমর্থন, কূটনৈতিকদের সমর্থন কিংবা কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতায় আরোহণের খুশিতে মিষ্টি বিতরণের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের কাতারে নেমে এসে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজনীতির ছক বাস্তবায়নের নিশানাই পারে বিএনপিকে রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দাঁড় করাতে। এর বাইরে সব ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হবে।
মো. সাখাওয়াত হোসেন : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়