বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক জোরদার করার অঙ্গীকার

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকে এই সম্পর্ক অনেক পুরনো। এই সম্পর্ক আরো ভালো হবে। এটা তো পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশী ভারতের যে কোনো ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

হীরেন পন্ডিত
স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তার প্রতিবেশী ভারতের সম্পর্কের সূচনা হয় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছায়। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রম্নয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই পারবে না এই মৈত্রীতে ফাটল ধরাতে।' বঙ্গবন্ধু দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি গড়েছিলেন, একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখন্ডতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত কূটনৈতিক সম্পর্কের পথেই চলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কৌশলগত পরিস্থিতির কারণে একে অন্যের বৈদেশিক নীতিতে দুই দেশই অগ্রাধিকার পেয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংযোগ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং শিল্পকলা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যেমন মিল রয়েছে- তেমনি এই বিষয়গুলোর প্রতি দুই দেশের মানুষের আবেগও প্রায় একইরকম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত বাংলাদেশের জন্য সরাসরি যুদ্ধে জড়ালেও, তাদের সীমান্ত খোলা রেখেছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের গণহত্যার শুরু থেকেই। নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচতে দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারত সরকার নানা অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে নিপীড়িত মানুষকে দীর্ঘ ৯ মাস আশ্রয় দিয়েছে ও খাদ্য দিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৯ জুন, ২০২৪ রোববার সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদকে নিয়ে নয়াদিলিস্নতে রাষ্ট্রপতি ভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, মরিশাস ও সিসিলির সরকার-রাষ্ট্রপ্রধানসহ আট হাজারের বেশি বিশিষ্টজন অংশ নেন। পরে রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর ভোজসভায় যোগ দেন তারা। ভারতে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন এনডিএ জোটের প্রধান নরেন্দ্র মোদি। জওহরলাল নেহেরু ছাড়া আর কোনো প্রধানমন্ত্রী টানা তিনবার শপথ নেওয়ার কৃত্বিত্ব পাননি। ৯ জুন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজিত শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের ৭২ সদস্যও শপথ গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে কংগ্রেস সভাপতি মলিস্নকার্জুন খাড়গে উপস্থিত থাকলেও এতে যোগ দেননি তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। মোদির পাশাপাশি তার মন্ত্রিপরিষদের ৭২ সদস্যও এ অনুষ্ঠানে শপথগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ক্যাবিনেট পদের মন্ত্রী ৩০ জন। স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী পাঁচজন। বিজেপির পাশাপাশি মোট ১১টি জোটসঙ্গীকে মন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়েছে। ৪৩ জন মন্ত্রী তিনবার বা তার বেশিবার এ দায়িত্ব পালন করেছেন। ৭২ মন্ত্রীর মধ্যে ৩৯ জনই আগের সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে উলেস্নখ করা হয়। কড়া নিরাপত্তায় ঘেরা জমকালো এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি বিজেপির ৯৬ বছর বয়সি সিনিয়র নেতা লালকৃষ্ণ আদভানির সঙ্গে তার বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. মুস্তাফিজুর রহমান জানান, 'বৈঠকে দুই নেতা তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলেন, এ ছাড়াও তারা পরস্পর সৌহার্দ্য বিনিময় ও অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেন।' এরপর সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে তৃতীয় বিদেশি নেতা হিসেবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বিজেপি এবার নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তাই সরকার গড়তে এনডিএ'র শরিক দলগুলোর ওপর পদ্মশিবিরকে অনেকাংশে নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে বিজেপি স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ, শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মতো 'গুরুত্বপূর্ণ' মন্ত্রণালয়গুলো নিজের হাতেই রেখেছে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বেশ কিছু বণ্টন করা হয়েছে শরিক দল চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি, নীতীশ কুমারের জেডিইউ, চিরাগ পাসোয়ানের এলজেপি (আর), একনাথ শিন্ডের শিবসেনা, এইচডি দেবগৌড়ার জেডিএস এবং জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডির মধ্যে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়াদিলিস্নতে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের এ কথা জানিয়েছেন। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিলিস্নর আইটিসি মৌর্য হোটেলে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি নরেন্দ্র মোদি এবং এনডিএ জোটকে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আবারও অভিনন্দন জানান এবং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। সোমবার সকালে হায়দরাবাদ হাউসে একান্ত বৈঠক করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। দুই নেতা নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম আলোচনায় বসেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আলোচনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এরই অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার ভারতে পরিকল্পিত দ্বিপক্ষীয় সফরের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। এ মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের কথা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ভবনে এ সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু'দেশের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে নরেন্দ্র মোদির নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আন্তরিক আগ্রহ ব্যক্ত করেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে এবং নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। মানুষে মানুষে সংযোগ বৃদ্ধিতে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নসহ উভয় দেশের আরও উন্নতিকল্পে আমাদের একযোগে কাজ করে যেতে হবে। ভারতের টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা। রাষ্ট্রপতি ভবনে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি একান্তে বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই নেতা বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আগামী দিনগুলোতে আরও দৃঢ় করার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ড. মাহমুদ বলেন, 'অত্যন্ত উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভারতীয় সমকক্ষকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।' নরেন্দ্র মোদি গত ১০ বছর গত ধরে তার রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এবং শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যে ১৬ বছর ধরে তার সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন এবং একে অপরের কাছ থেকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, 'দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয় জড়িত। যেহেতু উভয় সরকার দেশ পরিচালনায় অব্যাহত রয়েছেন, সেহেতু একসঙ্গে কাজ করার কিছু সুবিধা আছে। উভয় দেশের জনগণ বিভিন্ন দিক থেকে উপকৃত হচ্ছে- যার মধ্যে দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে যোগাযোগ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, 'আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত এবং আরো গভীর হবে।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পার্লামেন্টের রাজ্যসভা সদস্য ও কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী ও তার পুত্র লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ১০ জুন বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আইটিসি মৌর্য হোটেলে সাক্ষাৎ করেন তারা। এ সময় সোনিয়া গান্ধীর কন্যা ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে একান্তে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই সাক্ষাতের পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের ইউনিয়নমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠক হয়। বৈঠক দু'টির বিষয়ে পরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের ইউনিয়নমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের বৈঠকটিও হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল উলেস্নখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে এস জয়শঙ্করের আন্তরিকতার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পুনরায় মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানান ও একইসঙ্গে কাজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। এ মাসের শেষ দিকে আবার ভারত সফর করবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সফরের আগে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার অংশ নেয়া এবং মোদির সঙ্গে আলাদা বৈঠকের আলাদা গুরুত্ব আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের কথায়, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই ইঙ্গিত। সেটা বাংলাদেশের নির্বাচনের আগেও দেখা গিয়েছে। সামনেও দেখা যাবে। তবে তারা মনে করেন, 'এর ফলে, বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা বিভিন্ন অমীমাংসিত ইসু্য সমধানে কতটা কাজে আসবে ভবিষ্যৎই বলবে।' ভারতে সরকার পরিবর্তন হলে সাধারণত তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে তেমন পরিবর্তন হয় না। আর ভারতে তো ওই অর্থে সরকার পরিবর্তন হয়নি। মোদিই আবার ক্ষমতায়। পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে ভারতে একটা সাধারণ কনসেনসাস আছে। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে সেটা আরো নির্ধারিত। দলের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আসে না। মানুষের প্রত্যাশা বা চাহিদার ভিত্তিতে হয়তো কোনো জিনিস হাইলাইটেড হতে পারে। 'আসলে দুই দেশের কোনো দেশেই সরকার পরিবর্তন হয়নি। ওখানে হয়তো জোট থেকে কয়েকজন মন্ত্রী হয়েছেন। তাতে তো আর বিরাট কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবে না। দুই দেশের সম্পর্ক যেরকম আছে সেরকমই থাকবে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। আওয়ামী লীগের এক টার্ম তো ভারতে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিল। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় এলো। তখন তো অনেকে ভেবেছিল মোদি ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগের অনেক অসুবিধা হবে। কোনো অসুবিধা তো হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকে এই সম্পর্ক অনেক পুরনো। এই সম্পর্ক আরো ভালো হবে। এটা তো পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশী ভারতের যে কোনো ঘটনাই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সফল নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ হয়, ফল হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জোর করে শাসনের চেষ্টা করা হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। সরাসরি সমর্থন, আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং মাতৃসুলভ আচরণে খুব অল্প সময়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ছিনিয়ে আনে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন যেমন ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তেমনি ভারতের নির্বাচনও বাংলাদেশের কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ। নানা হিসাব-নিকাশে বাঙালি সমর্থনের দলটির পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক ধারবাহিকতা ভারতের জাতীয় নির্বাচন এখন সারাবিশ্বে একটি মডেল। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত তিনটি সরকারের আমলে যে দেশটির সঙ্গে তারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সে দেশটি নিঃসন্দেহে ভারত। এই ধারাবাহিকতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নতুন মেয়াদেও সেই ধারা বজায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও বাংলাদেশের গুরুত্ব বিগত দেড় দশকে ক্রমশ বেড়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবেও ভারত একাধিকবার বলেছে, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে বাংলাদেশই তাদের 'সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী'। এই সময়ে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, কানেক্টিভিটি বা সংযোগ, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন, স্থল ও সমুদ্রসীমায় বিরোধ নিরসন, বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি ইসু্যতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় অভাবনীয় অগ্রগতিও লক্ষ্য করা যায়। কোভিড মহামারি বা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ভারত দেখছে না। আইএমএফ বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবির মতো সংস্থায় ভারতের প্রভাব খুবই বেশি। ফলে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দরকার হলে ভারত অবশ্যই সাহায্য করবে বলে সবাই মনে করে। শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখেছেন। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এই মুহূর্তে বাংলাদেশের চীনকে প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ ভালো বন্ধু, প্রতিবেশী হিসেবে ভারত এই সত্য অবশ্যই বুঝতে পারছে। শেখ হাসিনা সরকার কখনো ভারতবিরোধী কার্যকলাপে কোনো শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেবে না। এই সত্য ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই প্রমাণিত হয়েছে। সরকার এই নীতি এখনো বজায়ে রেখেছে এবং ভারত এটা বিশ্বাসও করে। চীনের মতামত উপেক্ষা করে বাংলাদেশ 'কোয়াড' জোটে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ মনে করেছে এই জোটে অংশগ্রহণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন। শুধু মহান মুক্তিযুদ্ধ নয়, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কল্যাণে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠিত হওয়ায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই ঋণের কথা ভুলে যাননি। পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে ঢাকা ফেরার পথে তাই তিনি দিলিস্ন অবতরণ করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। ভারতের মাটিতে বসেই তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আন্তরিক সহায়তার জন্য ভারত সরকার ও সে দেশের জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এক কথায় ফিরিয়ে নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারতীয় সৈন্য। ২০২৪-এর শুরুতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কর্মতৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের প্রতিবেশী প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের সমর্থন আদায়েরও চেষ্টা করেছিল তারা। নরেন্দ্র মোদি সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। উপরন্তু তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে। এছাড়া করোনা মহামারির সময় ভারতই প্রথম আমাদের টিকা দিয়ে সহায়তা করেছে। গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদি তার যোগ্যতা দিয়ে অন্যতম বিশ্বনেতা হয়ে উঠেছেন। সঠিক বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে ভারতকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব রাজনীতিতে অনন্য উচ্চতায়। একজন চা বিক্রেতা থেকে এই ভারতীয় নেতা দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। তার পরিপক্ব রাজনীতি ভারতীয় জনতা দলকে পর পর তিনবার ক্ষমতায় বসাতে সক্ষম হয়েছে। হীরেন পন্ডিত : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট