শেখ হাসিনার কারামুক্তিতে গণতন্ত্রের মুক্তি

প্রকাশ | ১১ জুন ২০২৪, ০০:০০

মানিক লাল ঘোষ
মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরসূরি গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তাদের জন্য ১১ জুন একটি ঐতিহাসিক আনন্দ ও বিজয়ের দিন। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর দিন। ২০০৮ সালের ১১ জুন দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগের পর মুক্ত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসূরি গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার মুক্তির মধ্য দিয়ে মুক্ত হয় গণতন্ত্র। কেননা ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে বন্দি করার নামে সেদিন অবরুদ্ধ করা হয়েছিল গণতন্ত্রকে। ১/১১ তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেদিন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে মাইনাস (মাইনাস টু ফর্মুলা)-এর নামে মূল টার্গেট করেছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করার। এই টার্গেট ও পরিকল্পনা হঠাৎ করে নয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র ওদের অনেক দিনের। স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য ভয়ংকর একটি চ্যালেঞ্জের দিন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় সেদিন আজকের জননন্দিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসার জায়গা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার হীন প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। যদিও সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায় এ দেশের আপামর জনগণের প্রতিবাদী ভালোবাসার কাছে। আর এজন্যই দিনটি স্মরণীয়। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে এই দেশের গণতন্ত্রকে হত্যার নীলনকশা করেছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। তাই ইতিহাসের এই কালো দিনটিকে মুজিব আদর্শের নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রকামী দেশের আপামর জনগণ 'গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস' হিসেবে পালন করে। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ভোরে ফখরুদ্দিন-মইনউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বঙ্গবন্ধুকন্যাকে ধানমন্ডির নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের জন্য সুধাসদনের চারদিক বিভিন্ন বাহিনীর দুই সহস্রাধিক সদস্য ঘিরে রেখেছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনা এর মধ্যে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সাদা শাড়ি পরিহিতা শেখ হাসিনা যৌথবাহিনীর কাছে জানতে চান, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে? দেশে কী সামরিক শাসন জারি হয়েছে? কোনো উত্তর ছিল না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের মুখে। গ্রেপ্তারের আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নামে দেওয়া হয় একাধিক মামলা। বাসা থেকে তাকে পুলিশের একটি জিপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে তিনি নাজেহালের শিকার হন। সেদিন সিএমএম কোর্টে দাঁড়িয়ে বাঙালির আস্থা ও ভালোবাসার ঠিকানা শেখ হাসিনা সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আইনি ভাষায় ৩৬ মিনিট বক্তব্য দেন। সেই সকালেই অগণিত রাজনৈতিককর্মী নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে কোর্ট প্রাঙ্গণে ছুটে গিয়েছিলেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে। আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে। এরপর শেখ হাসিনাকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত তার বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ওইসব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। গ্রেপ্তারের পরই বঙ্গবন্ধুকন্যার মুক্তির দাবিতে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী তাকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কান ও চোখের চিকিৎসা নেন। দেশে ফেরার পর আবার তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। কারাবরণের পর প্রায় এক বছর বন্দি ছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা, অবরুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যানারে পদদলিত হয়েছিল ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। তবে ১/১১-এর অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের দেওয়া মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেও পরবর্তী সময়ে সেই অভিযোগ থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহতি পান বঙ্গবন্ধুকন্যা। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হয়, মুক্তির মিছিলে শামিল হয় লক্ষ-কোটি নেতাকর্মী। মুক্ত হয় অবরুদ্ধ গণতন্ত্র। ভাবতে কষ্ট হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছিলেন শেখ হাসিনা। বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাসী ও পুলিশ বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছে ৬৮ জন। সেই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। চারদলীয় জোটের ভোট কারচুপির নীলনকশা প্রতিহত করার জন্যই আন্দোলন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষা করে গণতন্ত্রকে সুসংহত করাও তার মূল টার্গেট ছিল। মূলত শেখ হাসিনার এই চিন্তা-ভাবনার বিপরীতে যাদের অবস্থান ছিল, তার নেতৃত্ব যাদের কাছে আতঙ্ক ছিল তাদের কারণেই সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এটাই ছিল তার অপরাধ। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'আন্দোলন করে দাবি পূরণ করলাম, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্গঠন করলাম। যেই দ্রম্নত নির্বাচনের কথা বললাম, সেই আমি চাঁদাবাজ হয়ে গেলাম, দুর্নীতিবাজ হয়ে গেলাম। আমার স্থান হলো কারাগারে। পাঁচটি বছর চারদলীয় জোট তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমার ও আমার পরিবারের দুর্নীতির কোনো কিছু পায় কি না, পায় নাই। পেয়েছে ফখরুদ্দীন সরকার।' অনেকেই বলেন মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়নে নেমেছিল ১/১১ সরকার। কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পেয়েছি আমরা? মামলা-হয়রানির শিকার বেশি হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট মাইনাস টু নয় 'মাইনাস শেখ হাসিনা' তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠীর। এই তো সেদিনের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সুদখোর, কালোটাকার মালিকরা টাকা সাদা করে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েছিল নতুন দল গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার। আর সরকারের পক্ষ থেকে ওই দলে যোগ দেওয়ার জন্য নানা রকমের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষনেতাদের। আর রাজি না হলে দুদককে দিয়ে রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল সরকার। একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা করা হচ্ছিল। ষড়যন্ত্র সফল না হলেও পরবর্তী সময়ে যেন তারা দলে বিতর্কিত হয় তারও ছক তৈরি করেছিলেন তারা। পরে দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনা দুঃসময়ের বাস্তবতা বুঝতে পেরে, তাদের আবার কাছে টেনে নেন। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৯টি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৬টি মোট ১৫টি মামলা করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বিরুদ্ধে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তার ভাবমূর্তি, বঙ্গবন্ধু পরিবারে ঐতিহ্য নষ্ট করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি বাঙালির আস্থা ও বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে এবং তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে দুদককে ব্যবহার করে। ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বিদেশি প্রতিষ্ঠান নাইকোকে অবৈধভাবে গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ এনে শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ৫ মে এ মামলায় ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। মামলার দায় থেকে অব্যাহতির জন্য শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে হাইকোর্টে বাতিল আবেদন করলে ৭ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করেন। এই রুলের ওপর শুনানি শেষে আদালত মামলাটি বাতিল ঘোষণা করেন। এভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় জননেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার পরিসমাপ্তি ঘটে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মামলাগুলো করা হয়েছিল বলেই তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলো উদঘাটিত হয়নি। এজন্য হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিধিমালার অসংগতি দূর করতে তা সংশোধনেরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর ওপর জননেত্রী শেখ হাসিনার আস্থার কারণেই শেখ হাসিনাকে আটকে রাখা যায়নি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। শেখ হাসিনা সেদিন চিঠিতে বলেছিলেন, সত্যের জয় হবেই। সেই জয়ের কারণেই ২০০৮ সালের ১১ জুন মুক্ত হওয়ার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বাংলার জনগণ শেখ হাসিনার ভালোবাসার প্রতিদান একবার নয়, পরপর তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনে দিয়েছেন। ভালোবাসার প্রতিদান শুধু ভালোবাসাতেই হয়, অন্যকিছুতে নয়। শুধু উন্নয়ন অগ্রগতি নয়, সাধারণ জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন, সামাজিক বেষ্টনীর মাধ্যমে বিশেষ করে বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযুদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, করোনাকালীন প্রণোদনা, অসহায় গৃহহীনদের আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের কল্যাণে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলার খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণ আর তাদের আস্থা ও বিশ্বাসের শেষ ঠিকানা জননেত্রী শেখ হাসিনার এই ভালোবাসার সেতুবন্ধন যেন কারও ব্যক্তিগত খায়েস আর কারও লোভের আগুনে পুড়ে ছাই না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মানিক লাল ঘোষ : সাংবাদিক